সুবল চন্দ্র সাহা : সংখ্যালঘুর সম্পত্তি কেনা কি দোষের? একজন সংখ্যালঘু হিন্দু নগদ টাকার প্রয়োজনে সংখ্যাগুরু মুসলমানের কাছে ন্যায্যমূল্যে জমি বিক্রি করলে ক্রেতাকে অহেতুক নানা দোষে দুষ্ট করার অপচেষ্টা আসলে কিসের ইঙ্গিত? এটি কি বিক্রেতা সংখ্যালঘুকে ভালোবেসে? না-কি ঘোলাজলে মাছ শিকারের চেষ্টা আছে এর মধ্যে। ন্যায্যমূল্য পাওয়া ওই সংখ্যালঘুর জন্য মায়াকান্নার ভান করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সাময়িক বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টার মাধ্যমে যদি কতিপয় স্বার্থান্বেষী অন্য কোনো মতলব আঁটেন তাহলে আমরা ওই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কী বলবো? মতলববাজ? কারণ তারা কোনোভাবেই সংখ্যালঘুর প্রকৃত হিতাকাক্সক্ষী নন। অসত্য তথ্য দিয়ে কারো সম্মানহানির চেষ্টায় যদি কোনো দুষ্টচক্রকে সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্য থাকে তাহলে এর দায় নিতে হবে ওই চক্রকেই।
আমি ফরিদপুরের অরুণ গুহ মজুমদারের আইনজীবী। গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর পক্ষে মামলা লড়ছি। ফরিদপুরে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। অরুণ গুহ মজুমদার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কাছে যে জমিটি বিক্রি করেছেন আমি তার শনাক্তকারী। কেনা-বেচার প্রথম সাক্ষী ফরিদপুরের বিশিষ্ট আইনজীবী নারায়ণ চন্দ্র দাস। দ্বিতীয় সাক্ষী দেবাশীষ সাহা। তিনিও একজন আইনজীবী। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, আমার মক্কেল অরুণ গুহ মজুমদারের উপর্যুপরি অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আমিই খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে পুরোনো ওই বাড়িটি কেনার অনুরোধ করি একাধিকবার। আমি সত্তরোর্ধ একজন আইনজীবীই শুধু নই। জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিও বটে। একাধিকবার জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ছিলাম। ফরিদপুর পৌরসভায় কয়েক দফায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছি। সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে মেয়র নির্বাচন করেছি। সর্বোপরি আমি ফরিদপুর জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদেরও জেলা কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য।
ফরিদপুরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষায় খন্দকার মোশাররফ হোসেন, তার পিতা খন্দকার নুরুল হোসেন ওরফে নুরু মিয়া ও গোটা পরিবারের ভূমিকা অসামান্য। গোটা জেলায় এটি প্রতিষ্ঠিত যে এই পরিবার বছরে পর বছর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আগলে রাখছেন তাদের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করছেন। অরুণ গুহ মজুমদার খন্দকার মোশাররফ হোসেন পরিবারের কাছ থেকে বরাবর ¯েœহ, মমতা ও অভিভাবকসুলভ আচরণ পেয়ে আসছে তা আমাদের খুব ভালোভাবেই জানা আছে। অরুণ গুহ মজুমদারের একমাত্র কন্যার ডাক নাম বন্যা। নামটি খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পিতার দেয়া। এ থেকেই দুই পরিবারের সম্পর্কের মাত্রা অনুমান করা যায়। অরুণ গুহ মজুমদার যে জায়গাটি বিক্রি করলেন তার একটি বড় অংশ অর্পিত সম্পত্তি ছিল। ফরিদপুরের একটি চিহ্নিত ভূমিদস্যু গোষ্ঠী কয়েক বছর আগে ওই জায়গা লিজ নেওয়ার চেষ্টা করলে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের হস্তক্ষেপে জেলা প্রশাসন অরুণ গুহ মজুমদারকে লিজ দেয়। পরবর্তীতে আইনি লড়াইয়ে পূর্ব পুরুষের জায়গার মালিকানা অরুণ গুহ মজুমদার ফিরে পান। যে চক্রটি সরকারের কাছ থেকে অরুণ গুহ মজুমদারের দখলে থাকা অর্পিত সম্পত্তি লিজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল তারা মূলত বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সুবিধাভোগী। অন্য এক হিন্দুকে মালিক সাজিয়ে বহু বছর আগের তারিখে (যখন ছবি দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রেশনের নিয়ম ছিল না) ভুয়া দলিল তৈরি করে রেখেছিল ওই গোষ্ঠীটি। বর্তমান সরকারের প্রশাসনযন্ত্র সব রকমভাবে অরুণ গুহ মজুমদারকে সাহায্য, সহযোগিতা করায় ওই চক্রটি পিছু হটতে বাধ্য হয়। চক্রটির হোতারা ওই ভুয়া দলিল যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাতিল করান। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা যা অরুণ গুহ মজুমদারের বিরুদ্ধে ছিল সেসব প্রত্যাহার করে নেন। এরপর সম্পূর্ণরূপে জমির মালিকানা অরুণ গুহ মজুমদার ফিরে পান। দীর্ঘদিন ধরে বেকার ষাটোর্ধ্ব অরুণ গুহ মজুমদার এবার স্বপ্নের জাল বুনতে থাকেন। জমিটি বিক্রি করে নগদ অর্থ পেলে শহরের অন্যত্র তার যে জায়গায় আছে সেখানে তিনি বাড়ি করে থাকবেন পাশাপাশি ব্যাংকে নগদ জমা রেখে তা দিয়ে অত্যন্ত সাচ্ছন্দ্যে জীবন অতিবাহিত করবেন। আমাকে তিনি বারংবার বলেন, নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে খন্দকার মোশাররফ হোসেন যদি জমিটি কিনতেন তাহলে তিনি সব ব্যাপারে আশ্বস্ত হতেন। অরুণ গুহ মজুমদারের উপর্যুপরি অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাকে নিয়ে খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে জমিটি কেনার প্রস্তাব দিই। প্রস্তাবের শুরুতে খন্দকার মোশাররফ হোসেন আমাকে বলেন, ‘সুবল, আমার ফরিদপুর শহরে পারিবারিক ও ক্রয় সূত্রে যথেষ্ট ভূসম্পত্তি রয়েছে। নতুন করে জমির তো আমার প্রয়োজন নেই। তুমি বরং অন্য কোনো ক্রেতার সন্ধান করো।’ কিন্তু অরুণ বলেন, ‘আমার টাকার প্রয়োজন। অন্য কেউ জমিটি কিনলে আমি শান্তি পাবো না। প্রায় শত বছরের পারিবারিক সম্পর্ক আমাদের। আপনি জমিটি কিনলে আমি নগদ টাকাও পাবো পাশাপাশি আমার ভালোও লাগবে।’ যাই হোক, এক পর্যায়ে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ঠিক আছে আমি আমার অন্য ভাইদের সঙ্গে কথা বলে পরে সিদ্ধান্ত জানাবো।’ অরুণ নাছরবান্দা। দু-একদিন যেতে না যেতেই আমাকে এসে বলতে থাকেন, ‘দাদা, মন্ত্রী মহোদয় কি কিছু জানিয়েছেন? একটু কথা বলে দেখেন তো।’ আবার যোগাযোগ করি। এভাবেই এক পর্যায়ে অরুণ মজুমদারের চাহিদা মতো সম্মানজনক দরে জমিটি কেনা-বেচা রফা হয়। দলিল লেখক বিজয় কৃষ্ণ দাস। জমিটি কেনা-বেচার শুরু থেকে শেষ রফা পর্যন্ত অরুণ গুহ মজুমদারের স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাও জড়িত ছিলেন।
অরুণ গুহর একমাত্র কন্যা বন্যা উচ্চ শিক্ষার জন্য ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি বৃত্তি নিয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। হাতে ও ব্যাংকে যথেষ্ট নগদ টাকা থাকার কারণেই অরুণ ও তাঁর স্ত্রী মানসিকভাবেও বেশ স্বস্তিতে আছেন। তারা কন্যার ভর্তির জন্য ভারতে গেছেন। পাশাপাশি এই সুযোগে আত্মীয় স্বজনের বাড়িও ভ্রমণ করছেন। মোটেও দেশত্যাগ করেননি। ফরিদপুর শহরে অরুণ গুহ মজুমদারের অন্য জমি রয়েছে। শহরতলীর ভাজনডাঙ্গাতেও জমি রয়েছে।
যে গোষ্ঠী অরুণ গুহ মজুমদারের কথিত দেশত্যাগের কল্পকাহিনি প্রচার করছে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এটি নির্দ্বিধায় বলতে পারি। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তকে প্রশ্নটি রেখেছিলাম। বলেছিলাম, ‘দাদা, আপনি কি প্রকৃত ঘটনা জানেন? আপনি কি অরুণের সাথে কথা বলেছেন? আমাদের সঙ্গে কথা হয়েছে?’ তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। এই দায়িত্ব জ্ঞানহীন আচরণ তার কাছ থেকে আশা করিনি। মূলত তিনিই তো বিনা কারণে বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘তিনি নাকি শুনেছেন, অরুণ গুহ মজুমদারের বাড়ি দখল হয়েছে। আর এলজিআরডি মন্ত্রীকে এজন্য সংশ্লিষ্টরা দায়ী করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করেছে। কার্যত নাম পরিচয়হীন দায়িত্ব জ্ঞানহীন ও স্বার্থান্বেষী মহলে অপপ্রচারকে গুরুত্বের সাথে প্রচার করে হিন্দু- বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানার ব্যবহার করা কতখানি যুক্তিসঙ্গত এই প্রশ্নও আমি রাখছি। বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী তো বটেই ১/১১-এর কুশিলবরাও চাইছেন যেনতেনো প্রকারে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে। তাই বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে তথাকথিত সুশীলরা। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিরাট ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই মনে করছি।
অরুণ গুহ মজুমদার ভারত ভ্রমণ শেষে কিছুদিনের মধ্যেই দেশে ফিরবেন। তার মুখ থেকেও প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। কিন্তু ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টাকারীরা যার সম্মানহানীর চেষ্টা করে গেলেন তাদের কী হবে?