
প্রবীর চৌধুরী রিপন :
সৌদি আরবে হজের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে মিনায় শয়তানের স্তম্ভে পাথর ছুড়তে গিয়ে পদদলিত হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার ভলাকুট ইউনিয়নের বালিখোলা গ্রামের দুই নারী মারা গেছেন বলে তাঁদের পরিবার লোকজন নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া একই পরিবারের তিন সদস্যসহ চারজন নিখোঁজ রয়েছেন। একইসাথে ওই গ্রামের আরও দুইজন সৌদি আরবে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনায় ইউনিয়নে চলছে শোকের মাতম। নিহতরা হলেন- বালিখোলা গ্রামের মৃত আলীম উদ্দিনের মেয়ে আমেনা বেগম (৫০) ও একই গ্রামের পশ্চিমপাড়া এলাকার বাসিন্দা তাঁর চাচাতো বোন ইদু মিয়ার স্ত্রী হাসিনা খাতুন (৬০)। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- বালিখোলা গ্রামের সাইজ উদ্দিনের ছেলে হাজী মো. আসাদুল্লাহ (৭৫), তাঁর স্ত্রী সায়েরা বেগম (৬০), ছোট বোন আউলিয়া বেগমের স্বামী একই এলাকার বাসিন্দা মৃত এলাজ উদ্দিনের ছেলে সিদ্দিক মিয়া (৬৫), তাঁর মামা কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের বাঙ্গালপাড়ার মৃত লাল মিয়ার ছেলে ওমর আলী (৭০)। গতকাল সোমবার দুপুরে হাওর বেষ্টিত বালিখোলা গ্রামের নিহত হাসিনা খাতুন ও নিখোঁজ হাজী মো. আসাদুল্লাহ বাড়িতে গিয়ে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা গেছে। ঢাকা তোপখানা বিজয়নগর এলাকার হাজরে আসওয়াত হজ্জ এন্ড ট্রাভেল ট্যুরস এজেন্সির মাধ্যমে আসাদুল্লাহ পরিবার ও আত্মীয়স্বজনসহ মোট আট জন হজ্জ পালন করতে সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে গত ৩০ আগস্ট রওয়ানা হন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের মিনায় ‘শয়তান স্তম্ভে’ পাথর ছোড়ার সময় পদদলিত হওয়ার সময় এই আটজন একই সাথে ছিলেন। মিনায় পদদলিত হওয়ার ঘটনার সময় আসাদুল্লাহর চাচাতো ভাই সায়েব আলী ও চাচী আলিমুন্নেছা কোন রকমে প্রানে বেঁচে যান।
নিহত হাসিনার ছেলে শওকত আলী জানান, দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া সায়েব আলী ও আলিমুন্নেছা বাংলাদেশে তাঁদের পরিবারকে আমেনা বেগম (৫০) ও হাসিনা খাতুনের (৬০) মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাঁদের বরাত দিয়ে নিখোঁজ হওয়া আসাদুল্লাহর ছেলে জসিম উদ্দিন জানান, দুর্ঘটনার প্রায় ৪৮ ঘন্টা পর বেঁচে আমেনা ও হাসিনার মৃত দেহ দেখতে পেয়েছেন বলে যাওয়া সায়েব আলী ও অলিমুন্নেছা দাবি। তার পিতা-মাতাসহবাকিদের তাঁরা খোঁজে পায়নি বলে জানিয়েছেন।
নারিসনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমদ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান হজ্জ পালন করতে গিয়ে মিনায় পদদলিত হয়ে ছয়জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে স্বজনরা জানিয়েছে।
কসবা ॥ গত বৃহস্পতিবার পবিত্র হজ্বের দিন মক্কা নগরীর মিনায় শয়তানের প্রতিকী স্তম্ভে প্রস্তর নিক্ষেপকালে হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে মারা যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার জাহেদুল ইসলাম ভুইয়া স্বপন (৪০) নামে আরেকজন হজ্বযাত্রী। তিনি উপজেলার খাড়েরা ইউনিয়নের খাড়েরা গ্রামের নুরুল ইসলাম ভূইয়ার ছেলে। এই নিয়ে কসবার দুইজন হাজীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ছোট ভাই খাইরুল ইসলাম ভূইয়া জীবনকে নিয়ে এবার পবিত্র হজ্ব করতে সৌদী আরবে যান জাহেদুল ইসলাম ভূইয়া স্বপন। রাজধানীর এয়াওয়ে ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরস’র মাধ্যমে মোয়াল্লেম হিসেবে মক্কায় যান তিনি। নিহতের বড়ভাই আমিনুল ইসলাম ভুইয়া তপন গত রোববার সাংবাদিকদের জানান, ‘বৃহস্পতিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে আমার ছোটভাই খাইরুল ইসলাম ভূইয়া জীবনের মাধ্যমে স্বপনের মৃত্যুর খবর পাই।’ নিহতের ভাই আরো জানান, মিনায় শয়তানের প্রতিকী স্তম্ভে প্রস্তর নিক্ষেপের সময় থেকে তাকে খোঁজে পাওয়া যায়নি। পরে মর্গে তার পরিচয়পত্র দেখে লাশ সনাক্ত করা হয়।’ জাহেদুল ইসলাম ভূইয়া স্বপন পরিবার নিয়ে ঢাকার বাসাবো এলাকায় বসবাস করেন। নিহত স্বপন এক পুত্র ও এক কন্যার জনক। নিহতের পরিবার এমনকি গোটা এলাকাজুড়েই এখন চলছে কেবল শোকের মাতম। পরিবার ও স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আত্বীয়-স্বজনরা এসে তাদেরকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকার বাসাতেও দোয়া, কোরান খতম আদায় করা হচ্ছে। গ্রামের মানুষও শোকাচ্ছন্ন। পুরো গ্রামজুড়েই যেন চলছে শোকের মাতম।
স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে পদদলনে স্বামী নিহত ॥ এদিকে একই দিনে পবিত্র হজ্বের দিন মক্কা নগরীর মিনায় শয়তানের প্রতিকী স্তম্ভে প্রস্তর নিক্ষেপকালে হুড়োহুড়িতে পড়ে যাওয়া স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মারা যান কসবা উপজেলার বাদৈর ইউনিয়নের মান্দারপুর গ্রামের গোলাম মোস্তফা খালেক (৬০) নামের আরেক হজ্বযাত্রী। এই ঘটনায় আহত হন নিহতের স্ত্রী রওশন আরা মৃধা। তাদের পরিবার এমনকি গোটা এলাকাজুড়েই এখন চলছে কেবল শোকের মাতম।
নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের টেলিকম বিভাগের (টিসিএম) অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী গোলাম মোস্তফা খালেক স্ত্রী রওশন আরা মৃধাকে নিয়ে এবার পবিত্র হজ্ব পালন করতে যান। রাজধানী ঢাকার বনানীর সাকের ট্রাভেলস এন্ড ট্যুর’স এর মাধ্যমে গত ২১ আগস্ট মক্কায় গিয়ে পৌঁছান এই দম্পত্তি। গোলাম মোস্তফার ছেলে ইয়াছিন গত শনিবার সাংবাদিকদের জানান, ‘বৃহস্পতিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে মোয়ালেম (হজের প্রশিক্ষক) সাইফুল ইসলামের মাধ্যমে আমরা আব্বুর মৃত্যুর খবর পাই।’ তিনি আমাদের জানিয়েছেন, আব্বা পদদলনের সময় আম্মাকে সেইভ (রক্ষা) করতে গিয়েই মারা গেছেন। আম্মা পড়ে যাওয়ার পরই আব্বা তাকে জড়িয়ে ধরে পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আব্বাই চলে গেলেন। এসময় আম্মাও পায়ে ব্যথা পান।’ গোলাম মোস্তাফার পরিবার ঢাকার আশকোনায় বসবাস করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি ব্রা?হ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার বাদৈর ইউনিয়নের মান্দারপুর গ্রামে। নিহত গোলাম মোস্তফা দুই পুত্র ও দুই কন্যার জনক। নিহতের পুত্র আরো জানান, ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া মায়ের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। হজ্বে গিয়ে তাদের বাবার মৃত্যুর ঘটনায় পরিবার ও স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আত্বীয়-স্বজনরা এসে তাদেরকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকার বাসাতেও দোয়া, কোরান খতম আদায় করা হচ্ছে। গ্রামের মানুষও শোকাচ্ছন্ন। নিহতের চাচাত ভাই জিতু মিয়া ও ভাতিজা নজরুল ইলাম জানান, গ্রামের মানুষও শোকাচ্ছন্ন। পুরো গ্রামজুড়েই যেন চলছে শোকের মাতম।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার পবিত্র হজ্বের দিন পবিত্র মক্কা নগরীর মিনায় পদদলনের ঘটনায় ৭৬৯ জন নিহত ও ৯৩৪জন আহত হয়েছেন বলে সৌদি সরকারের সিভিল ডিফেন্স সূত্রে প্রকাশ। এর মধ্যে বাংলাদেশেরও পাঁচজন রয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া আরও ১০৩ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে সংশিষ্ট হজ্ব এজেন্সিগেুলো সূত্রে জানা গেছে।