আমরা সময়ের কথা সময়ে বলি।

Advertisement

সিলেট-ঢাকা চারলেন: বাড়তি ব্যয়ে কাজ দিতে অর্থমন্ত্রীর সুপারিশ!

জাতীয় 6 June 2017 ২২

চীনের অর্থায়নে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য প্রকল্পটির ব্যয় প্রস্তাব করেছে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিএইচইসি)। তবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের প্রাক্কলনের চেয়ে এ দর প্রায় ৪২ শতাংশ বেশি। অত্যাধিক ব্যয়ের চায়না হারবারের প্রস্তাবে সম্মত নয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। তবে বাড়তি ব্যয়ে চীনের এ প্রতিষ্ঠানটিকেই কাজ দিতে সুপারিশ করেছেন অর্থমন্ত্রী।

সম্প্রতি চায়না হারবারের পাঠানো চূড়ান্ত প্রস্তাবের ওপরে হাতে লিখে সুপারিশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরে ওই চিঠিটি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে পাঠানো হয়।

সূত্র মতে, জিটুজি ভিত্তিতে চীনের অর্থায়নে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেন নির্মাণে গত বছর অক্টোবরে চুক্তি সই হয়। পরে প্রকল্পটির ব্যয় প্রাক্কলনে সওজের প্রধান প্রকৌশলীকে সভাপতি করে কারিগরি কমিটি গঠন করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। ওই কমিটি সওজের বিদ্যমান সিডিউল রেট ও চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে তুলনাপূর্বক প্রকল্পটির ব্যয় চূড়ান্ত করে।

এতে ঢাকার কাঁচপুর থেকে সিলেট পর্যন্ত ২২৬ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে নির্মাণে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ১০ হাজার ৩৭০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। তবে এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণ ব্যয় অন্তর্ভুক্ত নেই। আর চায়না হারবার এ ব্যয় প্রাক্কলন করে ১৬ হাজার ৩৪৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। দরকষাকষি শেষে তা কমিয়ে চূড়ান্ত প্রস্তাব করা হয় ১৪ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এ হিসাবে চার হাজার ৩৭৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বা ৪২ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি দর প্রস্তাব করে চীনা কোম্পানিটি।

জানতে চাইলে কারিগরি মূল্যায়ন দলের প্রধান ও সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান বলেন, সওজের প্রকল্পটির ব্যয় মূল্যায়ন প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। চায়না হারবারের চিঠিও মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তারা বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

এদিকে সওজের প্রধান প্রকৌশলীকে পাঠানো এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবে চায়না হারবার জানায়, সওজের প্রাক্কলনে ৭০ শতাংশ ইউনিটের মূল্য ধরা হয়েছে ২০১৫ সালের শিডিউল রেট অনুসারে। বাকি ৩০ শতাংশ ইউনিটের মূল্য ধরা হয়েছে ২০১৪ সালের বাজারদরের প্রেক্ষিতে। যদিও সওজের প্রস্তাবিত ব্যয় বাজারদরের চেয়ে বেশি তবে ঢাকা-সিলেট চার লেন জিটুজি-ভিত্তিক প্রকল্প। আর এ প্রকল্পে অন্যান্য জিটুজি প্রকল্পের চেয়ে তুলনামূলক কম ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ কর্ণফুলী টানেলে প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে ৫৮ শতাংশ ও পদ্মা রেল সংযোগ ৩৪ শতাংশ বেশি ব্যয়ে চুক্তি করা হয়।

চিঠিতে আরও বলা হয়, সওজের প্রস্তাবিত দর স্থানীয় ঠিকাদারদের ও ছোট প্রকল্পের জন্য প্রযোজ্য। তবে আন্তর্জাতিক ঠিকাদার ও বড় প্রকল্পে এ দর গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আন্তর্জাতিক ঠিকাদারদের ব্যবস্থাপনা সিস্টেম ও পরিচালনার আদর্শমান উচ্চ এবং তাদের বিভিন্ন ভারি যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। এদিকে জিটুজি প্রকল্পে নির্ধারিত তহবিলের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করা বাধ্যবাধকতা থাকে। কারণ প্রকল্প ব্যয় বাড়লে চীন সরকার বাড়তি তহবিলের জোগান দেবে না। তাই নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে সচেষ্ট থাকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

উপরিউল্লিখিত পরিস্থিতি পর্যালোচনায় প্রকল্পটির ইউনিট মূল্য ২০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করে চায়না হারবার। পাশাপাশি প্রকল্পটির যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন খাতে বরাদ্দ রাখা দরকার। সব মিলিয়ে প্রকল্প ব্যয় পড়বে ১৪ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

পরে আরেকটি চিঠিতে জিটুজিতে অনুমোদিত ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ব্যয় বিশ্লেষণ যুক্ত করে চায়না হারবার। এতে দেখা যায়, ঢাকা-সিলেট চার লেনের চেয়ে ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের প্রতিটি ইউনিটের ব্যয় বেশি।

চিঠির অনুলিপি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব, কারিগরি টিমের অন্যান্য সদস্য ছাড়াও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ও অতিরিক্ত সচিব এবং অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া হয়। পরে প্রস্তাবটি দ্রুত অনুমোদনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন অর্থমন্ত্রী। চায়না হারবারের পাঠানো ওই প্রস্তাবের ওপর অর্থমন্ত্রী  লেখেন- ‘প্লিজ রিলিজ দিস ইস্যু অ্যাট ইউর আর্লিয়েস্ট কনভেনিয়েন্স’।

এদিকে চায়না হারবারকে কাজ দিতে অনুরোধ করেছেন অর্থমন্ত্রীর ছোট ভাই ড. একে আবদুল মোমেন। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবকে পাঠানো এক ই-মেইল বার্তায় তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল, ঢাকা-মাওয়া ও ঢাকা-সিলেট চার লেন প্রকল্পের ব্যয়ের তুলনা করেন। এতে দেখা যায় কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হিসাবে ঢাকা-সিলেট চার লেন প্রকল্পটি হবে দেশের দ্বিতীয় ব্যয়বহুল মহাসড়ক।

পরে তিনি বলেন, ব্যয় বেশির জন্য যদি বাংলাদেশ সরকার চায়না হারবারের প্রস্তাব ফেরত দেয় তাহলে প্রকল্পটি দুই-তিন বছরের জন্য ঝুলে যাবে। কারণ এ ধরনের প্রস্তাব দ্রুতই পাওয়া যাবে না। তাছাড়া চায়না হারবার ২০১৮ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার আশ্বাস দিয়েছে। তাই ব্যয় বেশি হলেও কাজটি তাদের দেওয়া উচিত।

ঢাকা-সিলেট চার লেন প্রকল্প নিয়ে নানামুখী চাপের কারণে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ করেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক। বৈঠকে অর্থমন্ত্রী ঢাকা-সিলেট চার লেনের চূড়ান্ত প্রস্তাবটি দ্রুত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানোর অনুরোধ করেন। কমিটি বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনের কাজ শুরু করতে আর কোনো বাধা নেই। সব কিছু এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে ব্যয় নিয়ে তিনি মন্তব্য করেননি।