আমরা সময়ের কথা সময়ে বলি।

Advertisement

শেখ হাসিনা বলেছিলেন- যখন ঈদের শাড়ি কেনার বয়স, তখন বাবা থাকতেন জেলে

বিশেষ প্রতিবেদন 25 June 2017

সময়টা ১৯৯৪ সালের শুরুতে। ক্ষমতায় বিএনপি, বিরোধী দলে আওয়ামী লীগ। সংসদীয় গণতন্ত্রের নবযাত্রার কাল। সেনাশাসক এরশাদ কারাগারে। সংসদে জাতীয় পার্টির অবস্থান শক্তিশালী হলেও রাজপথে তারা কঠোর নিপীড়নের মুখে। এছাড়া খালেদা জিয়া প্রথম শাসনামল গণতন্ত্রের নবযাত্রায় চমৎকার ছিল। সেই সংসদের স্পিকার আব্দুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি হয়ে বঙ্গভবনে চলে গেলে তার জায়গায় আসেন মরহুম শেখ রাজ্জাক আলী। উদার, সহনশীল একজন স্পিকার হিসাবে সংসদে তিনি ভারসাম্য রক্ষা করতে পারতেন। আমি তখন একদিকে সংসদ কাভার করি, অন্যদিকে বাইরে আওয়ামী লীগ বিটের রিপোর্ট শোলক সন্ধানীর মতো খবর খুঁজে বেড়াই।

আজকের মতো তখনো ঢাকা এত যানজটে ডেথ সিটিতে পরিণত হয়নি। রিক্সা নিয়ে নানা দিক ছুটে বেড়ানো যেত। ২৫-৩০ টাকা হলেই বেবি ট্যাক্সিতে হুট করে চলে যাওয়া যেত যেখানে সেখানে। বাংলাবাজার পত্রিকা তখন কসকো গ্রুপের মালিকানাধীন হয়ে গ্রীণ রোড থেকে তেঁজগাওয়ে চলে গেছে। দেশের ৪ টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন  ঘিরে ভোটের হাওয়া একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে তুমুল প্রতিযোগিতায় সরকারি দল ও বিরোধী দল। দীর্ঘ ২১ বছর আওয়ামী লীগ যে ক্ষমতায় আসছে তার ইঙ্গিত এই নির্বাচনের ফলাফল প্রথম দিয়েছিল। বিশাল ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের মরহুম মোহাম্মদ হানিফ ঢাকার মেয়র নির্বাচিত হন। চট্টগ্রামে বিজয়ী হন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। শুধু রাজশাহীতে বিএনপির মিজানুর রহমান মিনু আর খুলনায় তৈয়ুবুর রহমানা বিজয়ী হন।

নির্বাচনের পরদিন পরাজিত শক্তির হাতে লালবাগ রক্তাক্ত হয়। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সরকার বিরোধী আন্দোলনের দুয়ার খুলে। মাগুরার উপনির্বাচনে নির্লজ্জ ভোট ডাকাতির ঘটনা দেশবাসীকে প্রবল ঝাঁকুনি দেয়। সরকারকে বেকায়দায় ফেলে। অন্যদিকে, বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল সকল বিরোধী দল নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের ইস্যু নিয়ে রাজপথে নামার সুযোগ পায়।

যে কথাটি বলছিলাম, এই মেয়র নির্বাচনে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসাবে শেখ হাসিনার তত্বাবধানে নেতাকর্মীরা আন্তরিকভাবে মাঠে নামে প্রবল জয়ের নেশা নিয়ে এবং বিজয় নিয়েই ঘর ছাড়ে। তখনো ভোটের ময়দানে বিএনপির আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভারত জুঁজুর প্রচার রয়েছে। ঢাকার মেয়র নির্বাচনের পর সংসদে বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা গেলেন আজমীর শরীফে। সঙ্গে ছোটবোন শেখ রেহানা। যেদিন ফিরলেন সেদিন ছিল এরকম ঈদুল ফিতরের দু’তিন দিন আগে। দিনটি ছিল শুক্রবার। পাঞ্জাবি, কালোপ্যান্ট আর স্লিপার পায়ে রিলাক্স মুডে গেছি অফিসে। ঈদের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী জানতে চাইলেন, হাতে কিছু আছে কি না? অর্থাৎ, রিপোর্ট খুঁজলেন।

একজন রিপোর্টারের জীবনে কোনো রিপোর্ট ছাড়া অফিসে প্রবেশ লজ্জা ও গ্লানির। পেশার তারে নিজের জীবনকে জড়ানোর পর এটাই আমার উপলব্ধি। রিপোর্টিং জীবনে কমদিনই গেছে, রিপোর্ট ছাড়া অফিসে গেছি। কখনোই আমি ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গেও সিন্ডিকেট রিপোর্টে জড়াই নি। সেদিন মতিউর রহমান চৌধুরীর প্রশ্নের জবাবে বললাম, হাত খালি। তবে শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন। তিনি জানতে চাইলেন, কখন? বললাম, বিকালেই চলে আসবেন। বললেন, চলে যান আপনি এয়ারপোর্টে।

এয়ারপোর্টে সেদিন দু’চার জন যারা হাজির হয়েছিলেন তাদেরকে ভিআইপি লাউঞ্জে ঢুকতে দেয়া হয়নি। মরহুম আব্দুর রাজ্জাকসহ একে একে নেতারা ঢুকছিলেন তাদের নেত্রীকে অর্ভ্যথনা জানাতে। আমি মরহুম রাজনীতিবিদ আব্দুর রাজ্জাকের ভাঙা জিপে উঠে ভিতরে প্রবেশ করি এবং ভিআইপি লাউঞ্জে চলে যাই। তখন আমরা যেখানে শেখ হাসিনা, সেখানেই হাজির। সংসদ হোক, সংসদের বাইরে হোক এমনকি ঢাকার বাইরে হলেও সঙ্গে গেছি। শেখ হাসিনা খুব উৎফুল্ল চিত্তে বিমান থেকে নেমে ভিআইপি লাউঞ্জে এসে ঢুকলেন। নেতাদের ফুল আর কুশল বিনিময়ের পরে চা চক্রে বসলেন। মুড ভালো দেখে আমি প্রশ্ন শুরু করলাম। তিনি তার স্বভাবসুলভ মিডিয়াবন্ধব চরিত্র ফুটিয়ে তুলে বলতে লাগলেন, ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। লোকসভার স্পিকার তাকে সংসদ ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। তারা তাকে অনেক বই উপহার দিয়েছেন। সংসদীয় রাজনীতির প্রতি তার হৃদয় নিঃসৃত দরদ চোখে মুখে ফুটে উঠছিল।

একটা রিপোর্ট করার জন্য অনেক তথ্যই আমার হাতে চলে এসেছে। এরমধ্যে টাঙ্গাইলের মরহুম রাজনীতিবিদ আব্দুল মান্নান কম কথা বলতেন। তিনিই বলে উঠলেন, মিডিয়ায় এসব বলার দরকার নেই। হাসি খুশি প্রাণবন্ত মুখেই শেখ হাসিনা বললেন, ‘এগুলো লিখবে না, সব অফ দ্যা রেকর্ড।’ অফ দ্যা রেকর্ড শব্দটিকে আমার সব সময় মিডিয়া স্বীকৃত প্রহসন ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না। একুশের বইমেলায় আমার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থটির নামও অফ দ্যা রেকর্ড।

বিরোধী দলের নেতা যখন সব আলোচনা যখন অফ দ্যা রেকর্ড বলেদিলেন, আমার মাথায় তখন ভাঁজ পরলো। এই কষ্ট করে আসা এবং সকল অর্জন মুহুর্তেই শেষ হয়ে গেল। ভিতরে তুমুল অস্থিরতা। দু’দিন পরেই ঈদুল ফিতর। চট করে জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘মাননীয় নেত্রী, আপনি ঈদের শাড়ি কিনেননি? তিনি এক মুহুর্ত আমার দিকে তাকালেন। মুখে তার হঠাৎ বিষাদের ছায়া নেমে এল। বললেন, ‘যখন ঈদের শাড়ি কেনার বয়স ছিল, তখন বাবা থাকতেন জেলে। আর ৭৫ এর হত্যাকাণ্ডের পর ঈদ আসেনি আমাদের জীবনে।’ তার থেকে একটু দূরে বসা শেখ রেহানার চোখ তখন ছলছল। ভিআইপি লাউঞ্জে নেমে এল খানিক নিরবতা। কথা শেষ করেই তিনি বেরিয়ে এলেন। গাড়িতে যখন উঠতে যাবেন তখন আজকের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বলে উঠলেন, ‘শুনেন পীর সাহেব, সব অব দ্যা রেকর্ড।’ আমার অহমে চট করে লেগে গেল। আমিও তাৎক্ষণিক বলে উঠলাম, ‘যেখানে মাননীয় বিরোধী দলের নেত্রী বলেছেন, অফ দ্যা রেকর্ড, সেখানে আপনি বলার কে?’ শেখ হাসিনা এক মুহুর্ত আমার দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন। গাড়ির আশপাশে জড়ো হওয়া দলের দুই একজন একটু অসন্তোষ নিয়ে ভ্রু কুচকালেন।

আমি অফিসে দৌঁড়ে এসে রিপোর্ট লিখে দিলাম। পরদিন শিরোনাম ছিল, ‘যখন ঈদের শাড়ি কেনার বয়স, তখন বাবা থাকতেন জেলে।’ রিপোর্ট পড়ে আওয়ামী লীগের ভিতরের-বাইরের অনেকেই ধন্যবাদ জানালেন। তখন আজকের মতো মোবাইল হাতে হাতে ছিল না। পলিটিকেল বিটে কখনো একজন, কখনো বা দুজন  একই সঙ্গে সংসদ, সংবাদ সম্মেলন, জনসভা, বিশেষ রিপোর্ট, এক্সক্লুসিভ নিউজ সবই দিতে হতো। বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা তখন ২৯ মিন্টু রোডের লাল বাড়িটিতে থাকতেন। সংসদ থেকে পদত্যাগ করার দু’দিন আগে বাড়িটি ছেড়েছিলেন। তখন সেখানেও আমাদের নিয়মিত যেতে হতো। ঈদের পর ফিরে এসে এক সন্ধ্যায় মিন্টু রোডে গেলে বাহাউদ্দিন নাসিম আমাকে বুকে টেনে নিয়ে ভিতরে গেলেন। চা পান করাতে করাতে বললেন, ‘খুব সুন্দর লিখেছেন। ভয় পেয়েছিলাম, না জানি কি লিখে ফেলেন?’ বাহাউদ্দিন নাসিমের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বরাবরই উষ্ণ।

আওয়ামী লীগের রাজনীতির দুঃসময়ে বিটে যারা রিপোর্ট করতাম, তাদের অভিভাবকত্ব করতেন সিনিয়র হিসাবে আজকের প্রেসক্লাব সভাপতি শফিকুর রহমান। শেখ হাসিনার সহকর্মীদের মধ্যে মৃণাল কান্তি দাস, বাহাউদ্দিন নাসিম, নজিব আহমেদরা গণমাধ্যমকর্মীদের সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ-খবর নিতেন, সুসম্পর্ক রাখতেন। বিরোধী দলের নেত্রীর প্রেস সচিব আবু তৈয়ব বারবার তার নেতৃত্বের পক্ষে মানবিক রিপোর্ট করাতে তৎপর থাকতেন। সেই সময়ে আজকের মতো গণমাধ্যম এমন প্রযুক্তি নির্ভর ছিল না। নিউজরুম এত সুসজ্জিত ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছিল না। তখনো কর্পোরেট আগ্রাসনের কবলে পতিত হয়নি গণমাধ্যম। রাত ৮ টা, সাড়ে ৮ টায় নিউজ কাভার করে অফিসে যেতাম। রাজনীতি যখন টালামাটাল থাকতো তখন বের হতাম রাত দেড়টা, দুটায়। কাজটিতে মনের সুখ পেয়েছিলাম, তাই ইবাদতে মতো নিয়েছিলাম।

মাগুরা নির্বাচনের দিন নিউজ কাভারে সহকর্মী মনোয়ারুল ইসলাম মাগুরায় ছিলেন। এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। সন্ধ্যার দিকে আমি গেলাম মিন্টু রোডে খবর নিতে। সুনশান নিরবতায় ভিতর থেকে বেরিয়ে আসলেন বগুড়া থেকে নির্বাচিত এমপি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল মান্নান। সিগারেট ধরিয়ে ধরিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি রাকসুতে ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচন করোনি?’ বুঝলাম-সুরটা ভালো নয়। বললাম, হ্যাঁ করেছি। কিন্তু এখন তো প্রফেশনাল রিপোর্টার। তিনি পাল্টা জানতে চাইলেন, তুমি সেদিন নেত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইন্ডিয়া থেকে শাড়ি এনেছেন কিনা? এমন বিকৃত করে প্রশ্ন উত্থাপন দেখে বিস্মিত হইনি। বললাম, এইভাবে প্রশ্ন আমি করিনি। এরমধ্যে দুই একজন মারমুখী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এলেন। একসময় শেখ হাসিনা দেশে আসার পর তার দাপুটে রাজনৈতিক সচিব হয়ে উঠেছিলেন জাহিদ হোসেন সেন্টু। তিনি বললেন, জানেন, এই প্রশ্ন বেগম খালেদা জিয়াকে করা হলে, আপনাকে হুট খোলা জীপে তুলে নেয়া হতো। আমি বললাম, কেন? ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টার মার্গারেচ থেচারকে যদি সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে পারে, তার সামারের ফ্যাশন কি? তাহলে আমার দেশের নেত্রীকে ঈদের শাড়ি কিনেছেন কিনা, এই প্রশ্ন করা যাবে না? এতে তারা আরো ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন।

আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তখন আব্দুল মান্নান খান ফুট ফরমায়েস করেন। তিনি এই জটলা দেখে এসে আমার বক্তব্য শোনার আগেই বলে উঠলেন, ছি, ছি, এমন প্রশ্ন আপনারা করেন কিভাবে? অফিসে এসে ব্যথিত চিত্তে আমি বলেছিলাম, এই দলের বিটে আর রিপোর্টিং করবো না। মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে অকাল প্রয়াত বার্তা সম্পাদক আহমেদ ফারুক হাসান আমাকে অনেকক্ষণ বুঝিয়ে শান্ত করলেন। যারা অশুভ আচরণ করেছিলেন, তারা সেদিনের সেই মানবিক রিপোর্ট পড়েননি। আর আমার আক্ষেপ ছিল, সংসদীয় রাজনীতির প্রতি শেখ হাসিনা যে আন্তরিকতা দেখেছিলাম এবং তিনি সেখানের সংসদ, কার্যক্রম এবং বই পুস্তক নিয়ে আসার খবরটি রিপোর্ট করতে পারিনি। নেতারা অনেক সময় পরামর্শ দেন। সেদিনই মনে হয়েছে, সব পরামর্শ যে ঠিক দেন; তা কিন্তু নয়। জাহিদ হোসেন সেন্টু পরে সুপ্রিম কোর্টে আইনপেশায় নিয়োজিত হন। শেখ হাসিনার রাজনীতির ত্রি-সীমানায় জায়গা হয়নি।

শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে এক দুপুরে রোদে পুড়ে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রবেশ করেছিলেন। যাকে খুঁজে গিয়েছিলেন, তাকে পাননি। দেখে আমার মায়া লাগছিল। তাকে বসিয়ে ঠান্ডা জল আর চা পানে আথিতেয়তা দিয়ে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছি। বলিনি, সেই দিনের ঘটনা ভুলে যাইনি।