
সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও সেই ঘোষণা পৌঁছেনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারে। শীর্ষ কারা কর্মকর্তাদের ইন্ধনে পুরনো ফ্রি স্টাইলে এখনো চলছে ব্যাপক অনিয়ম। অভিযোগ রয়েছে- কারাবন্দী কারো সাথে তাদের স্বজনরা দেখা করতে গেলেই লাগে টাকা, কথা বলতে গেলে লাগে টাকা। আরামে খেতে এবং ঘুমাতে গেলেও লাগে টাকা। সম্প্রতি ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলা কারাগার এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করতে গেলে কারাবন্দী, বন্দীর স্বজন ও কারাগার সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে পাওয়া গেছে এসব অভিযোগ। তবে এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে কারাগারের জেল সুপার নুর-উন-নবী তার কারাগারে প্রকাশ্যে অনিয়ম, দুর্নীতি লুটপাটের বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করে নয়া দিগন্তকে টেলিফোনে বলেন, ‘ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলখানা এখন তো মডেল জেলখানা’। যারা অনিয়মের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা লাগিয়ে আমি এখনই অ্যাকশনে যাচ্ছি। কারাগারের অভ্যন্তরে কারা ক্যান্টিন ও বাইরের কারা ক্যান্টিন থেকে প্রতি মাসে সাত-আট লাখ টাকা কারা কর্মকর্তাদের দিয়েই ব্যবসা করতে হচ্ছে এমন অলিখিত চুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলো সব মিথ্যা কথা। যারা বলছে তারা মিথ্যা কথা বলছে। ২৭ জানুয়ারি রোববার বেলা সোয়া ১১টা। রাস্তাসংলগ্ন কারাগারের প্রধান গেটে প্রবেশ করার মুহূর্তেই সশস্ত্র কারারক্ষী আজাদ আগতদের তল্লাশি করে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছিলেন। মহিলারা প্রবেশ করতে গেলে গেটের পাশে ছোট রুমে তল্লাশি শেষে অনুমতি পাচ্ছেন। কারণ একটাই, ভেতরে মোবাইল নিয়ে কেউ যাতে প্রবেশ করতে না পারে। হেঁটে কারাগারের মূল গেটে যাওয়ার আগেই দু’টি রুমে টেবিল চেয়ার পেতে দু’জন কারারক্ষীকে বসে থাকতে দেখা যায়। এদের মধ্যে একজন মসজিদের দানবাক্সের উপর আগতদের সাক্ষাতের নাম-ঠিকানা লিখছেন। একটু ফ্রি হলে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন চালাচ্ছেন। মসজিদের দানবাক্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কারারক্ষী ১০ টাকার স্লিপ কাটছেন। আর পাশের কারারক্ষী ১০০ টাকার বিনিময়ে সাক্ষাতের টিকেট কাটছেন। এরপরও আরেকটি সাক্ষাৎ হচ্ছে কারাগারের মূল গেটে গিয়ে মুখোমুখি (ভিআইপি) সাক্ষাৎ। এখান থেকে কেউ দেখা করতে চাইলে লাগে ৫০০ টাকা। কারারক্ষী রাসেল এ প্রতিবেদককে দেখে এগিয়ে এসে কানে কানে বললেন, ভেতরে কারো সাথে দেখা করবেন? হ্যাঁ বললে তখন তিনি বলেন, ভিআইপিভাবে দেখা করিয়ে দেবো। ৫০০ টাকা দিলেই চলবে। এত বেশি টাকা কেন? এর জবাবে তিনি বলেন, ১০ টাকা আর ১০০ টাকায় দেখা করলে পারবেন। কিন্তু সময় নষ্ট হবে। কেউ কারো কথা বুঝবেন না। তখন তাকে জানানো হলো আমার আরো দু’জন লোক আসবে। তারা এলেই আমরা দেখা করব। ১০ টাকার সাক্ষাৎকক্ষের পাকা বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছিলেন সম্প্রতি এই কারাগার থেকে জমি সংক্রান্ত মামলায় জামিনে মুক্তি পাওয়া জসিম উদ্দিন ও তার এক স্বজন। কারাগারের ভেতরের পরিস্থিতি কেমন জিজ্ঞেস করতেই জসিম বলতে শুরু করলেনÑ কারাগারের ভেতরের অবস্থা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হলেও খাওয়া দাওয়ার মান অত্যন্ত খারাপ। আর আরামে থাকতে হলে মাসিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা খরচ করতে হয়। খাবার মান প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি পাঁচ-ছয় মাস আগে যখন ছিলাম, তখন সকালের নাস্তা দেয়া হত একেবারে কালো, শক্ত রুটি। এই রুটি মনে হয় কুত্তারে দিলে সেও খাইব না, কিন্তু সেটি খেতে হয়েছে। আর ভাতে থাকে শুধু পাথর। যে সইজ রান্না করে আমাদের দেয়া হতো সেটি ঠিকভাবে ধোয়াও হতো না। আনাম তরকারি বাজার থেকে এনে বটি দিয়ে কেটে সোজা চুলোয় উঠিয়ে দিতো। এখন কী অবস্থা সেটি ভেতরে আমার যে লোক আছে তার কাছে বর্তমান পরিস্থিতি জানব। পরে তিনি দেখা করে এসে এ প্রতিবেদককে বলেন, আগে থেকে খাবারের মান নাকি কিছুটা উন্নত হয়েছে। তবে ভেতরে বন্দী নিয়ে বাণিজ্য চলছে জমজমাটভাবে। প্রথম দিন কোনো বন্দী কারাগারে এলেই আমদানি সেলে তার সাথে কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা থাকা-খাওয়ার চুক্তি করছে। মোট কথা একজন বন্দী যদি এই কারাগারে একদিনও অবস্থান করে তাহলে তাকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে তারপর বের হতে হবে। এটা এখানকার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ভেতরে মাদকের মামলার আসামি বেশি। তার সাথে কথা বলে পুনরায় মেইন গেটের দিকে গেলে তখন দেখা যায়, কারারক্ষী আজাদ আগত এক দম্পতিকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, সাধারণ সাক্ষাৎ ১০ টাকা। কিন্তু একই স্থান থেকে আপনাকে দ্রুত দেখা করানো হবে। এজন্য দিতে হবে ১০০ টাকা। স্লিপ পাঠানোর সাথে সাথে আপনার আসামি চলে আসবে। আর ১০ টাকার স্লিপ কাটলে আসামি সাড়ে ১২টার আগে আসবেই না। আবার নাও আসতে পারে। পরে ওই দম্পতি ১০০ টাকার স্লিপ কেটেই সাক্ষাৎ রুমে যান। তখন এ প্রতিবেদকসহ অপেক্ষা করলেও আসামি আসার খবর নাই। এ সময় কারাবন্দী আসামি মিজানুর রহমানের বড় ভাই ওসমান এ প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ১০ টাকার স্লিপে সাক্ষাতের নামেই তারা আমার কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়েছে। এটা স্রেফ বাটপারি ছাড়া আর কিছু না। অনেকক্ষণ পরও ওই আসামির দেখা পাননি তারা। এ সময় ওসমান তার ভাই গ্রেফতারের ব্যাপারে বলেন। তার ভাই গাঁজাসহ ধরা পড়েছে। কিন্তু নবীনগর থানার দারোগা উলিউল্লাহ তাকে ইয়াবার মামলায় ফাঁসিয়ে আদালতে পাঠিয়েছেন বলে দাবি করেন। একই থানার অপর এক মামলার আসামির বাবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার ছেলে ছোট। বয়স ১৭। তাকে দুই সপ্তাহ আগে পুলিশ ধরে ইয়াবার মামলায় চালান দিয়েছে। তিনিও দারোগা উলিউল্লাহর কথা জানিয়ে বলেন, পুলিশ যখন অভিযান চালায় তখন বাড়ির সামনেই তার রাজমিস্ত্রির কাজ করা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। যাদের ধরতে গিয়েছিল তারা মানিব্যাগ ফেলে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে আসে। আমি অনেকভাবে দারোগা স্যারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, আমার ছেলের মানিব্যাগ এটা না। কিন্তু পুলিশ শোনেনি। তাকে দুই পিস ইয়াবা ট্যাবলেট দিয়ে চালান দিয়েছে। এর আগে, দারোগা তার ছেলেকে ছেড়ে দেবে বলে আট হাজার টাকাও নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তারপরও ছাড়েননি। ছেলে কারাগারে কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ও তো শুধু তার মাকে দেখলেই কান্দে। ক্যান্টিন থেকে এক প্যাকেট চানাচুর, বিস্কুটসহ মোট ২৫০ টাকার খাবার কিনে দিয়ে আসলাম। শুধু তারাই নন; এ কারাগারে এখন ফ্রি