
ঢাকা।।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৭ জানুয়ারি ২০১৯ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেছেন। এর আগেও তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেছিলেন। কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করার ঘটনা বিরল। তিনি পরিদর্শনে গিয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা এবং কার্যক্রমের মনিটরিং করেন, সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন। এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। আমাদের দেশের প্রশাসনে বড় একটা দুর্বলতা রয়েছে যে, নিয়মিত যথাযথ মনিটরিং, সুপারভিশন এবং ফলোআপ করা হয় না। এটা সর্বজন বিদিত যে, প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তার কার্যালয়ে বা গণভবনে বসে সব কাজের নজরদারি করেন। সেদিন তিনি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং মেডিকেল শিক্ষার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে ডাক্তার-নার্সদের উপস্থিতি এবং তাদের কর্মস্থলে সুবিধা-অসুবিধা, নিরাপত্তার কথাও বলেছেন, অসুবিধা সমাধানের কথাও বলেছেন। আমি মনে করি, এতে স্বাস্থ্য প্রশাসন উপকৃত হয়েছে ও সংশ্নিষ্ট সবাই সচেতন হয়েছেন এবং আরও দায়িত্ববান হয়েছেন। এখন আমাদের সংশ্নিষ্ট সবার, বিশেষ করে স্বাস্থ্য প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উচিত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসরণ করে যেসব ভুলত্রুটি, অনিয়ম রয়েছে, তা সংশোধন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে সব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সফলতা, সীমাবদ্ধতা, অনিয়ম, চিকিৎসকদের স্বল্পতা, হাসপাতাল ভাংচুর, নিরাপত্তা, আবাসন সমস্যাসহ নানা প্রতিকূলতার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সব বিষয়ে দৃষ্টি রাখার জন্য আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা আশাবাদী, অনেক বাস্তব সমস্যার সমাধান দ্রুত হবে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, রয়েছে বাজেট ও জনশক্তির স্বল্পতা। এর পরও গত ২ জুন ২০১৮ তারিখে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটের গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ও মানসূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও আফগানিস্তানের ওপরে।
প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের পরপরই কিছু কিছু গণমাধ্যম কেবল চিকিৎসকদের সমালোচনায় জড়িয়ে পড়ল। মনে হলো, সব অব্যবস্থার জন্য কেবল চিকিৎসকরাই দায়ী- মুখোমুখি করা হলো চিকিৎসকদের গণমাধ্যম ও জনগণের। অনিয়ম, অব্যবস্থা যা আছে, তা সংশোধন করতে হবে – এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।
গত দশ বছরে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে- বেড়েছে অবকাঠামো, জনশক্তি, বাজেট, চিকিৎসার সুযোগ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিকায়ন এবং উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ। এর পরও বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৭ কোটি মানুষের অর্ধেকের কাছাকাছি মানুষকে আধুনিক চিকিৎসা দেওয়া গেছে।
চিকিৎসার মান উন্নয়নে কিছু বিষয় দেখা জরুরি-
১. চিকিৎসকের জীবনযাপন : প্রখর মেধা নিয়ে দুর্দান্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে একজন মেডিকেল ছাত্রকে ভর্তি হতে হয় দু’চোখ ভরা স্বপ্ন, দেশপ্রেম ও মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প নিয়ে। মেডিকেল কলেজ জীবন শুরু হয় আবাসন সমস্যা, নিম্নমানের খাবারসহ নানা সংকট নিয়ে। নতুন করে বড় সংকট হিসেবে দাঁড়িয়েছে তীব্র শিক্ষক সংকট। এত সংকটের মধ্যে তারুণ্য প্রাণবন্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে দেশ ও পরিবারের কাছে নানা দায়বদ্ধতা নিয়ে চিকিৎসক হিসেবে বেরিয়ে আসে। ছাত্রাবস্থায় একটা সাধারণ অভিযোগ থাকে, মেডিকেল ছাত্রের পেছনে রাষ্ট্রের নাকি সবচেয়ে বেশি খরচ হয়। বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, মেডিকেল ছাত্রের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের পেছনে রাষ্ট্রের বেশি খরচ হয়। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ডাক্তার হলেই সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শুধু পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ পেতে হয় স্বল্পসংখ্যক মেডিকেল অফিসার পদে। শেখ হাসিনা সরকার প্রায় ছয় হাজার ডাক্তার অ্যাডহক নিয়োগ দিয়েছিল। সম্প্রতি ১০ হাজার নিয়োগ দিয়েছে এবং সামনে আরও দশ হাজার নিয়োগের প্রস্তুতি চলছে। এখন প্রায় ৫০ হাজার ডাক্তার বেকার রয়েছে। এদের সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কেউ অনেক কষ্ট করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করছে। কেউ কেউ লজ্জাজনক বেতনে ক্লিনিকে অনিশ্চিত চাকরি করছে।
গ্রামে যেতে চায় না বা থাকতে চায় না :একটি ঢালাও অভিযোগ ডাক্তারদের শুনতে হয় তাহলো- জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো চলছে কীভাবে? হয়তো কোথাও কোথাও অনিয়ম আছে- সেখানে ব্যবস্থা নিলেই তো শুধরিয়ে যাবে। কিছু সমস্যা তো প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছে, সেসব দেখতে হবে।
বাংলাদেশের সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা :এটি বাংলাদেশের জন্য খুবই গৌরবের বিষয়। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সরকারের দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছেন। তাঁর ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এর উন্নয়ন, সম্প্রসারণ, আধুনিকায়ন করে চলেছেন। এ রকম সরকারি ব্যবস্থা বিশ্বে আর কোথাও খুব একটা পাওয়া যাবে না।
নিরাপত্তাহীনতা :গত ৫-৭ বছরে চিকিৎসকের ওপর এবং হাসপাতালে অসংখ্য হামলা হয়েছে। সাতক্ষীরা, বগুড়া, ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল, সলিমুল্লাহ মেডিকেল ইমার্জেন্সিসহ গোটা দেশে চিকিৎসক হামলা, হত্যা-ধর্ষণ, হাসপাতাল ভাংচুর হয়েছে। তেমন কোনো প্রতিকার বা ব্যবস্থা গ্রহণ লক্ষ্য করা যায়নি। বিশেষ করে ইমার্জেন্সি বিভাগে চিকিৎসক-নার্স-কর্মচারীরা প্রতিনিয়ত হামলার আতঙ্কে ভোগে।
দুর্নীতি :স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রায়ই বড় বড় দুর্নীতির খবর আমরা দেখতে পাই। বড় অঙ্কের অর্থ লোপাট, অপ্রয়োজনীয় মহামূল্যবান যন্ত্র ক্রয় করে ফেলে রাখাসহ নানা খবর, নানা অভিযোগ। যারা রোগীদের জীবন রক্ষার অর্থ লুটপাট করে, তাদের ব্যাপারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে উন্নত বিশ্বের চিকিৎসা ব্যবস্থা তুলনা করা ঠিক হবে না। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সব মহলকেই ভিন্নভাবে দেখতে হবে, চিকিৎসকদের তো বটেই। কারণ এ ব্যবস্থায় মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে কাজ করতে হয়।
এ লক্ষ্যে সুপারিশ হলো- স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণ :যে কোনো কাজ শুরুর আগে তার প্রশাসনিক ব্যবস্থা সঠিক করে নিতে হয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা খুবই নাজুক ও অকার্যকর। বাস্তবিকপক্ষে স্বাস্থ্য সচিব থেকে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক খুবই ব্যস্ত। তাদের পুরনো দায়িত্ব বণ্টন এখন অবাস্তব। প্রতিটি কাজের যে মনিটরিং, সুপারভিশন এবং ফলোআপ করা দরকার, এ ব্যবস্থায় সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য প্রশাসন কাঠামো পুনর্মূল্যায়ন করে বাস্তব দায়িত্ব বণ্টন এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাজেট :জাতীয় বাজেটের নূ্যনতম দশ ভাগ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দিতে হবে। নিয়োগ ও বদলি নীতিমালা : দেশে কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়োগ ও বদলি নীতিমালা নেই। এটিই তরুণ চিকিৎসকদের হতাশার অন্যতম কারণ। তরুণ চিকিৎসকদের বদলির ধাপ এবং উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সংবলিত একটি কার্যকর ঈধৎৎরবৎ চষধহহরহম দরকার। তাহলেও কিছুটা হতাশা দূর হবে। দূরবর্তী বা দুর্গম চিকিৎসা কেন্দ্রের পদায়নের জন্য আলাদা আর্থিক রহপবহঃরাব যুক্ত করা প্রয়োজন।
বিএমডিসিকে শক্তিশালী এবং কার্যকর করতে হবে :প্রায় ১৫ বছর বিএমডিসি মামলাধীন এবং অকার্যকর ছিল। বর্তমানে কিছুটা কার্যকর হয়েছে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ এ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা নানা দুর্বলতায় নিমজ্জিত।
বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালনা : দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থারও অনেক উন্নয়ন হয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো কার্যকর নীতিমালা নেই। বিশেষ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক-নার্স, জনবল ও নিয়মিত বেতন কাঠামোসহ কার্যকর নীতিমালা থাকতে হবে; যাতে চাকরিরত চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য জনবল চাকরির নিশ্চয়তা পেতে পারে। বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা প্রয়োজন।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করা :প্রতিটি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে পুলিশ ফাঁড়ি বা পুলিশের বিশেষ স্কোয়াডের ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসক আক্রমণ এবং হাসপাতালে ভাংচুরের জন্য দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
আঞ্চলিক প্রশাসনিক বিন্যাস :কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করা, যোগাযোগ করা বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সমস্যা সমাধান করা বাস্তবমুখী নয়। প্রয়োজনীয় জনবল, অবকাঠামো ও ক্ষমতা প্রদান করে জেলা বা নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন।
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বাস্থ্য প্রশাসন :স্থানীয়ভাবে জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বাস্থ্য প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হবে। সচিবালয় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যন্ত প্রশাসন চিকিৎসক সংগঠনের প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে, যাতে প্রশাসন নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও আইনানুগভাবে কাজ করতে পারে। এ বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এবং হাসিমুখে সেবা দিতে হবে যেমন, তেমনি রোগী ও স্বজনদের থাকতে হবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সহযোগিতা এবং সহনশীলতা।
আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রীর পরবর্তী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের পূর্বেই তার দিকনির্দেশনার সমস্যা সমাধানের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী যেন সন্তুষ্টি নিয়ে ফিরতে পারেন মন্ত্রণালয় থেকে।