আমরা সময়ের কথা সময়ে বলি।

Advertisement

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অম্লান দুই নাম সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মনি।

জাতীয়, মুক্তমত 27 March 2019 ৬১৪

ঢাকা।।

সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মনি। এই দুটি নাম বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরঅম্লান। দু’জনই ছিলেন মেধাবী ও প্রখ্যাত ছাতনেতা, রাজনীতিবিদ। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এই দু’জনই ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের জন্য গোটা বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রাখেন সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মনি। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ যতকাল টিকে থাকবে; ততদিনই ইতিহাসের পাতায় অম্লান, অক্ষয় থাকবে এই দু’জনের নামও।

সিরাজুল আলম খান বাঙালির ‘জাতীয় রাষ্ট্র’ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষে ১৯৬২ সালে গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন। নিউক্লিয়াস ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নমেও পরিচিত। এছাড়াও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গঠন এবং ‘সিপাহী জনতার গণ-অভ্যুত্থান’ এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি। তাকে বলা হয় বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্যপুরুষ। বিদেশে বসবাসের পাশাপাশি প্রায়ই দেশে এলে নির্দিষ্ট কিছু স্থানে তার বিচরণ দেখা যেত। তবে কয়েক বছর ধরে তিনি প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে। বর্তমানে তিনি অসুস্থ। ২০০৬ সালে লন্ডনের হাসপাতালে তার বাইপাস সার্জারি করা হয়েছিল।

আর বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি ও স্বাধীকার আন্দোলনের আরেক নক্ষত্র শেখ ফজলুল হক মনি একাধারে ছিলেন রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা। স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যতম প্রধান গেরিলা বাহিনী ‘মুজিব বাহিনী’ তার নির্দেশে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত এবং পরিচালিত হয়। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকদের বুলেটে বঙ্গবন্ধু ও অন্যদের সঙ্গে তিনিও নিহত হন।

সিরাজুল আলম খানের জন্ম ও শিক্ষা

সিরাজুল আলম খান ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার আলীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করে চলে যান বাবার কর্মস্থল খুলনায়। ১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। তারপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। থাকতেন ফজলুল হক হলে। গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর ‘কনভোকেশন মুভমেন্টে’ অংশগ্রহণ করার কারণে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। প্রতিদিন রাত করে হলে ফিরতেন। এই কারণে হল থেকেও একবার বহিষ্কৃত হন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় তার পক্ষে আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সিরাজুল আলম খান মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষায়তনে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

সিরাজুল আলম খানের রাজনৈতিক জীবন

সিরাজুল আলম খান ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় স্কুলের ছাত্র থাকাকালে প্রথম মিছিলে যান। পরে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাঙালি জাতীয়াতাবাদী চেতনাকে বিকশিত করে বাঙালিদের স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ’৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যে নিউক্লিয়াস গড়ে ওঠে তিনিই ছিলেন সেটির মূল উদ্যোক্তা। তারপর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে সকল কর্মকা্ল পরিচালনা করেন। ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র্ত্র মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন।

সিরাজুল আলম খান ১৯৬৩-’৬৪ এবং ১৯৬৪-’৬৫ এই দুই বছর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২-’৭১ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন, ৬-দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলন, ১১-দফা আন্দোলন পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করে তার সৃষ্ট ‘নিউক্লিয়াস’। আন্দোলনের এক পর্যায়ে গড়ে তোলা হয় নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক উইং বি.এল.এফ এবং সামরিক ইউনিট ‘জয় বাংলা বাহিনী’।

সিরাজুল আলম খানের দক্ষতা ও গবেষণা

সিরাজুল আলম খানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অঙ্ক শাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেলজীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। যার কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গড়ে উঠে তার অগাধ পা্লিত্য ও দক্ষতা। সেই কারণে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের অসকস বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৯৬-’৯৭ সনে।

আর্থ-সামাজিক বিশেষণে সিরাজুল আলম খানের তাত্ত্বিক উদ্ভাবন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়। মার্কসীয় ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’- এর আলোকে বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী হিসেবে বিভক্ত করে ‘রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক’ মডেল হাজির করেন সিরাজুল আলম খান। সিরাজুল আলম খান দেশে-বিদেশে ‘রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে পরিচিত। তার দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবন বর্ণাঢ্যের।

শেখ ফজলুল হক মনির শিক্ষাজীবন

শেখ ফজলুল হক মনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বর। ঢাকা নবকুমার স্কুল থেকে ১৯৫৬ সালে এসএসসি, ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে এইচ.এস.সি, ১৯৬০ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে বি.এ, ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ. এবং আইনে ডিগ্রি লাভ করেন।

শেখ ফজলুল হক মনির রাজনৈতিক জীবন

শেখ ফজলুল হক মনি ১৯৬০-১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় তিনি গ্রেফতার হন এবং ছয মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৪ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তত্কালীন গভর্নর আবদুল মোনেম খানের কাছ থেকে সনদ গ্রহণে তিনি অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তী সময়ে তিনি মামলায় জিতে ডিগ্রি ফিরে পান। ১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন এবং দেড় বছর কারাভোগ করেন। ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়ে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি কারারুদ্ধ হন। এসময় বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: মৃত্যুদূত মিনিবাস

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শেখ মনির উদ্যোগে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শেখ মনি ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

(উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।)