ঢাকা।।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরুঙ্কুশ বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ক্ষমতাসীন এই দলটি গতানুগতিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে তাদের সাংগঠনিক কর্মকান্ডে বেশকিছু নতুন কৌশল যোগ করেছে। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, ক্ষমতায় থাকা দলীয় সরকারের চৌকষ পরিকল্পনায় সারাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে এবং জাতীয় পর্যায়ের এই উন্নয়নের সুবিধা সহজেই জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে আর ভোটারদের ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাইতে হবে না। বরং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে উন্নয়নের এই ধারা ব্যাহত হতে পারে, এই শঙ্কায় সর্বস্তরের ভোটার স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে।
এদিকে সাধারণ ভোটারদের কাছে টানতে সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালাবে আওয়ামী লীগ সরকার। কেননা, বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে মুষ্টিমেয় প্রভাবশালী মানুষ জড়িত। অথচ এর দায়ভার দেশের ১৬ কোটি মানুষকে কোনো না কোনোভাবে বহন করতে হয়। তাই দুর্নীতি দমনে সরকার সোচ্চার হলে সরকারের প্রতি জনআস্থা বাড়বে। যাতে পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগ লাভবান হবে। যা দলের জন্য ইতিবাচক ক্ষেত্র তৈরি করবে বলে মনে করেন দলীয় হাইকমান্ড।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের গত দুই মেয়াদে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও এর যথেষ্ট প্রচার-প্রচারণা না থাকায় এসব ব্যাপারে সাধারণ মানুষ বেশখানিকটা অন্ধকারে ছিল। যার ফলশ্রম্নতিতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাধারণ ভোটারদের ভোট সংগ্রহে নৌকার মাঝিদের বেশখানিকটা বেগ পেতে হয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এখন থেকে প্রতিটি উন্নয়ন কর্মকান্ড জনসম্মুখে তুলে ধরতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে তাগিদ দেবে সরকার। পাশাপাশি দলীয়ভাবেও এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালানো হবে বলে জানান দলের নীতিনির্ধারকরা।
দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে পদ্মা সেতুর উন্নয়নকাজ বন্ধ হয়ে যাবে- এমন আশঙ্কায় এই সেতুর ভবিষ্যৎ উপকারভোগী সর্বস্তরের ভোটার গত নির্বাচনে ঢালাওভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। এমনকি খোদ বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরাও অনেকে এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়েছে। তাই পদ্মা সেতু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া যে ২১ জেলার মানুষের ভাগ্য বদলে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে, ওইসব এলাকায় নৌকার পক্ষে ভোটের পালস্না অনেক ভারী হয়েছে। যা সর্বস্তরের মানুষ নিঃসংকোচে স্বীকার করেছে। তাই চলতি মেয়াদে প্রতিটি উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে জনগণকে অবহিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডীলর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে দেশের মানুষ উন্নয়ন চায়। আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষের চাহিদা পূরণে বদ্ধপরিকর। মানুষের উন্নয়নই রাজনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। এ লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এরই মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। গ্রামের মানুষ বিদু্যৎ পাচ্ছে; শিক্ষা সহজলভ্য করা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়েই দেশ ও দেশের জনগণের উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।’
তবে আওয়ামী লীগের এই দায়িত্বশীল নেতা মনে করেন, ‘দেশে উন্নয়ন হলে কিছু সমস্যাও থাকে। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে চায়। তাই তাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে বহুদূর নিয়ে যেতে চায়।’
দল ও সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের একাধিক সূত্র জানায়, নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী, দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো আরও শক্তিশালী করতে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এরইমধ্যে বহুমুখী পরিকল্পনা তৈরি করেছে সরকার। এতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হলে পণ্য ও জনশক্তি রপ্তানি বাড়বে। ফলশ্রম্নতিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি বড় অংকের রেমিট্যান্স আসবে। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে, বাড়বে কর্মসংস্থান। একইভাবে দেশীয় উদ্যোক্তারাও বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারবেন। এতে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে। এসব উদ্যোগ সফল হলে দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষমতার পটপরিবর্তনের বিষয়ে অনাগ্রহী হয়ে উঠবে বলে মনে করেন দল ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি মূলত একটি উন্নয়ন দর্শন। এই উন্নয়ন দর্শনে সারা বিশ্বকে যুক্ত করার একটি কৌশল রয়েছে আওয়ামী লীগের। পোশাক, চামড়া ও পস্নাস্টিকের পাশাপাশি অসংখ্য প্রডাক্ট বাংলাদেশ রপ্তানি করছে। রপ্তানি বাড়াতে হলে অর্থনৈতিক কূটনীতি একটি বড় বিষয়। তিনি বলেন, রেমিট্যান্স অর্জনে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়েছে। একইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। এসব বিষয়ের সঙ্গে শুল্ক-অশুল্কজনিত অনেক বিষয় জড়িত। যেহেতু উৎপাদন বাড়ছে, এ কারণে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করাও একটি বড় দায়িত্ব। অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার হলে এসব বিষয়ের সহজ সমাধান করা সম্ভব।
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করাও সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা, বড় দুর্নীতির মূলে রয়েছে প্রশাসনিক ক্ষমতাধররা, অন্যদিকে রয়েছে প্রভাবশালী রাজনীতিকরা। তাই তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে হলে সরকারের পাশাপাশি দলীয় অবস্থানও জোরাল হতে হবে। প্রশাসনিক শক্ত ভিত গড়ে তোলা না গেলে যেমন আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে না, তেমনি সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকলে দুর্নীতিবাজ নেতাদের কোণঠাসা করা কঠিন হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
যদিও চলতি মেয়াদে সরকার গঠনের পর প্রথম কর্মদিবসেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা স্পষ্টভাবে জানান দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং এর অর্জনসমূহ সমুন্নত রাখার জন্য সরকার দুর্নীতিবিরোধী লড়াই অব্যাহত রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যদিও কোনো দেশের পক্ষেই শতভাগ দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়, তবে আমাদের সরকারের একটা দায়িত্ব হলো এই দুর্নীতি প্রতিরোধ করা, যাতে এটি দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে না পারে এবং আমাদের সব সাফল্য ম্স্নান করে না দেয়। সন্ত্রাসবাদ, দুর্নীতি ও মাদক নির্মূলের ক্ষেত্রে আমাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে।’
এদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জেহাদ ঘোষণা যে রাজনৈতিক কোনো বক্তব্য নয়, এর প্রমাণ ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারি সূত্রগুলো জানায়, নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংকিং খাতের অর্থ আত্মসাতের মামলাগুলো দ্রম্নত তদন্ত এবং বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই খাতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও দুর্নীতিগ্রস্তদের পদোন্নতি বন্ধ এবং বিদেশে অর্থ পাচার রোধে টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য বিশেষ তদারকি সেল খোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সম্পদের হিসাব বিবরণী হালনাগাদ, আর্থিক তথ্যাবলী জাতীয় নেটওয়ার্কের আওতায় আনার কাজ চালু করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী তার মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব সংগ্রহ করেছেন। সরকারের ‘সবুজ সংকেত’ পেয়ে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা দুদক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ বেশকিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার মনে করছে, এর ফলে দুর্নীতি দৃশ্যমান হারে কমে আসবে।
এদিকে নবনিযুক্ত মন্ত্রীরাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরাল ভাষায় কথা বলছেন। বুড়িগঙ্গার দুইপাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে বিস্ময়কর গতি পেয়েছে। গত কয়েক যুগেও প্রভাবশালীদের যেসব অবৈধ স্থাপনা ভাঙতে সাহস পায়নি, সেটা নিমেষেই গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যা দেশের মানুষকে হতবাক করে তুলেছে। অভিযানের এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট চাইতে তাদের কাছে আসতে হবে না বলেও নদীপাড়ের অনেকে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে।
যদিও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, সরকারকে প্রথমে নিজের ঘর থেকেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করতে হবে। প্রথম দুই মেয়াদে, অর্থাৎ বিগত ১০ বছর ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে যারা হৃষ্টপুষ্ট হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে না।
তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোনো দেশেই দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী ইশতেহার এবং দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারপ্রধান এখন পর্যন্ত যা বলেছেন, তা রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। এর ফলে জনমনে আশার সঞ্চার হয়েছে।’
[gs-fb-comments]Copyright © 2023 Amaderkatha | Design & Developed By: Design Ghor