আমরা সময়ের কথা সময়ে বলি।

Advertisement

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুসন্তান, লোকগানের বিশাল বাতিঘর অমর পাল আর নেই

সারাদেশ 21 April 2019 ৪৮৩

ব্রাক্ষণবাড়িয়া।।

উপমহাদেশের কিংবদন্তী লোকসঙ্গীত শিল্পী অমর পাল ২০ এপ্রিল শনিবার বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে কোলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। এক দশক আগে তিনি স্ত্রী পুতুল রানীকে হারিয়েছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি ৫ পুত্র, পুত্রবধু, নাতি নাতনী, অগণিত সঙ্গীত-শিষ্য, ভক্ত-অনুরাগী রেখে গেছেন। আগামী ১৯ মে ছিল তাঁর ৯৯তম জন্মদিন। বলা যায়, জন্মদিনের ঠিক একমাস আগেই চলে গেলেন তিনি। লোকসঙ্গীতের আঙিনায় তিনি ছিলেন একজন বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘হীরক রাজার দেশ’-এ তাঁর গান ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’ চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।আজও শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্রই মানুষের মুখে মুখে গীত হয় অমর পালের গান। ভারত সরকারের সংগীত-নাটক আকাদেমি পুরস্কারসহ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লালন পুরস্কার ও সংগীত মহাসন্মান অর্জন করেছেন তিনি। এছাড়া বহু বাংলা ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলা থিয়েটারের সঙ্গেও ছিল তাঁর নিবিড় যোগাযোগ। ১৯২২ সালের ১৯ মে, বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মধ্যপাড়ায় তাঁর জন্ম। ছোটবেলা থেকেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন তাঁর মা দুর্গাসুন্দরী পালের কাছে। ১০ বছর বয়েসে বাবা মহেন্দ্র চন্দ্র পালকে হারিয়ে সংসারের দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ছোট ভাই, উস্তাদ আয়েত আলি খান-এর কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন। বাংলায় লোকসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করেছেন যাঁরা, প্রয়াত শিল্পী অমর পাল ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ভারত ভাগের পরে কলকাতায় পাড়ি জমান ১৯৪৮ সালে এবং ১৯৫১ সালে তাঁর প্রথম গান সম্প্রচারিত হয় আকাশবাণীতে। তিনি হলেন প্রথম লোকশিল্পী যিনি গান গেয়েছেন আকাশবাণীতে। তাঁর কণ্ঠে অনেক গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। বহু চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দান করেছেন তিনি। এর মধ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকারের নাম উল্লেখ করতেই হয়, যাদের ছবিতে তাঁর গান সাধারণ মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে। ‘হীরক রাজার দেশ’-এর সেই বিখ্য়াত গানটির কথা তো সবাই জানেন। দেবকী কুমার বসু থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষ, বাংলা ছবির সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত বিচ্ছুরণ ঘটেছে তাঁর প্রতিভার। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি লিট উপাধিও পেয়েছেন এই গুণী শিল্পী। এছাড়াও দেশ-বিদেশের বহু সন্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। সারাজীবন ধরে আমাদের বিভিন্ন ধারার শিকড়ের গানকে উপহার দিলেও প্রভাতী ও ভাটিয়ালী গান যেন অমর পালের কণ্ঠে এক অন্যমাত্রা পেয়েছে লোকসংগীতপ্রিয় মানুষের হৃদয়ে।বর্তমান সময়ের সঙ্গীত পরিচালকদ্বয় সৌরেন্দ্র-সৌম্যজিৎ দীর্ঘ সময় তাঁর সান্নিধ্যে থেকেছেন। কিংবদন্তি শিল্পীর প্রয়াণের খবরে তাঁরা গভীরভাবে শোকাহত। শোকবার্তায় তাঁরা বলেছেন , ”লোকসঙ্গীত খুবই কঠিন। অমর পাল সেই ধারাটিকে সহজতর করে তুলেছিলেন তাঁর গায়কী দিয়ে। তাঁর গায়কী এতটাই মাটির কাছাকাছি ছিল যে শুনতে শুনতে মনে হয় প্রকৃতি যেন কাঁদছে, কাঁদছে শিল্পী অমর পালের কণ্ঠ দিয়ে।’ অমর পালের গাওয়া খুব জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘প্রভাত সময়ে’, ‘জাগো হে এ নগরবাসী’, ‘রাই জাগো’, ‘প্রভাতে গোবিন্দ নাম’, ‘রাই জাগো গো’, ‘ভারতী গৌরাঙ্গ লইয়া’, ‘হরি দিন তো গেল’, ‘মন রাধে রাধে’, ‘বৃন্দাবন বিলাসিনী’, ‘জাগিয়া লহো কৃষ্ণ নাম’, ‘আমার গৌর কেনে’, ‘আমি কোথায় গেলে’ ইত্যাদি। তিনি বিশ্বব্যাপী লোক সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। তিনি টোকিও, বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন লোকসঙ্গীত সম্মিলন এবং কর্মশালায় রিসোর্স পারসন হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন। অমর পাল কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গীত একাডেমির ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাঙালি লোকসঙ্গীত ক্ষেত্রে তাঁর অব্দানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ স্টেট একাডেমী অফ ডান্স, মিউজিক এন্ড ভিস্যুয়াল আর্টস, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ সঙ্গীত একাডেমী, বাংলাদেশের দৈনিক সমতট বার্তা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় শতবর্ষপূর্তি মহোৎসবে সম্মানিত হন।