আমরা সময়ের কথা সময়ে বলি।

Advertisement

ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে –এডঃ গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক

সারাদেশ 5 November 2021 ৩৫৯

ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে –এডঃ গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক

কুমিল্লা, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, নােয়াখালীর চৌমুহনী, রংপুরের পীরগঞ্জ সহ দেশের ২২টি জেলায় দুর্গাপুজা মন্ডপ হামলা ও ভাংচুরসহ বিভিন্ন ঘটনা পরিকল্পিত এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণােদিত। তারা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ করেন এডঃ গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক।
আজ শুক্রবার সকাল ১০টায় ঢাকা রিপােটার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ বিপু হলে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এ কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব এডঃ গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক।
সংবাদ সম্মেলনে দাবি জানানো হয়, ক্ষতিগ্রস্ত সকল মন্দির বাড়ী ঘর পূনঃ নির্মান ও ক্ষতিগ্রস্থদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপুরন দিতে হবে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদে ৬০টি সংরক্ষিত আসন ও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পূণঃ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, একটি সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে একজনকে পূর্ণমন্ত্রী নিয়ােগ করতে হবে।
সরকারকে দাবি মানার সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিতে আল্টিমেটাম দিয়েছে হিন্দু মহাজোট। অন্যথায় হিন্দু সম্প্রদায় সারা দেশের প্রত্যেক জেলা ও উপজেলা সদরে মানব বন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করে পরবর্তী কর্মসূচী ঘােষণা করবে।
হিন্দু মহাজোটের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডঃ দ্বীন বন্দু রায়,সহ-সভাপতি প্রদীপ চন্দ্র পাল, প্রধান সমন্বয়কারী বিজয় কৃষ্ণ ভট্টাচার্য, প্রেসিডিয়াম মেম্বার অভয় কুমার রায়, যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডঃ প্রদীপ কুমার সরকার, নকুল চন্দ্র মন্ডল, শ্যামল কান্তি নাগ,আন্তর্জাতিক সম্পাদক নরেশ হালদার, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক অ্যাড প্রতীভা বাকচী, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডঃ অচ্যুতানন্দ ঘরামী, সমাজ কল্যাণ সম্পাদক সঞ্জয় চক্রবর্তী, দপ্তর সম্পাদক কল্যাণ মন্ডল, ঢাকা উত্তরের সভাপতি প্রবীর হালদার, ঢাকা দক্ষিনের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল ঘােষ, ঢাকা জেলার সাধারণ সম্পাদক গােপাল পাল, খগেশ রাজবংশী, হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক মহাজোটের সভাপতি অ্যাডঃ গৌরাঙ্গ মন্ডল, সাধারণ সম্পাদক চুলন চন্দ্র পাল, সাংগঠনিক সম্পাদক চয়ন বাড়ে, হিন্দু যুব মহাজোটের সভাপতি প্রদীপ শঙ্কর, নির্বাহী সভাপতি গৌতম সরকার অপু, সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মৃণাল মধু, হিন্দু ছাত্র মহাজোটের সভাপতি সাজেন কৃষ্ণ বল, সাধারণ সম্পাদক সজিব কুন্ডু, প্রধান সমন্বয়কারী ধ্রুব বারুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্বপন মধু প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, দুর্গাপুজা হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। হিন্দু সম্প্রদায় ব্যপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দুর্গা উৎসবকে বরন করে নিয়েছিলাে। কিন্তু দুর্গা পুজা চলাকালে কুমিল্লা, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, নােয়াখালীর চৌমুহনী, রংপুরের পীরগঞ্জ সহ দেশের ২২টি জেলায় দুর্গাপুজা মন্ডপ ও হিন্দু বাড়ীঘরে ব্যাপক হামলা, ভাংচুর, পুজা মন্ডপ ও প্রতিমা ভাংচুর, লুঠপাঠ, অগ্নি সংযােগ, মঠ মন্দিরে হামলা, নির্যাতন, মহিলাদের শ্লীলতাহানী, ধর্ষন খুন সহ এক বিভিষীকাময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
হিন্দু মহাজোট কেন্দ্রীয় কমিটি, নারায়নগঞ্জ মহানগর কমিটি, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি ও সংশ্লিষ্ট জেলা কমিটি পৃথক পৃথকভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঘটনার ভয়াবহতা, পিছনে কারা দায়ী এবং কাদের অবহেলা তা উদঘাটনের চেষ্টা করেছেন।
কুমিল্লায় ১৩ অক্টোবর সকাল ১০ থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত দফায় দফায় হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযােগ এর ঘটনা ঘটলেও পুলিশ, র্যাব, ফায়ার সার্ভিসকে বার বার ফোন করে পুজামন্ডপ রক্ষার আকুতি জানালেও কেউ আসে নাই। সমস্ত পুজা মন্ডপ লন্ড ভন্ড করে গান পাউডার ছিটিয়ে প্রতিমা মণ্ডপ ধর্মপুস্তক সহ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোন কোন পতিমা পুজা মন্ডপ থেকে রাস্তায় নিয়ে এসে পদদলিত করে চরম সম্মানহানি করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মন্দিরের গেট ও আসে পাশের দোকানও রেহাই পায় নাই। কোন রাজনৈতিক নেতা সামাজিক নেতা সুশীল সমাজ কেউ এগিয়ে আসে নাই। ঘটনার পরদিন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ীঘর ও মঠ মন্দিরে ব্যপক ভাংচুর, লুঠপাট, অগ্নি সংযােগ, মহিলাদের শ্লীলতাহানী, ধর্ষনের ঘটনা ঘটে। নােয়াখালীর চৌমুহনীতে ব্যপকভাবে হিন্দু মন্দির ও পুজামন্ডপে হামলা অগ্নি সংযােগ ভাংচুর হয়।
রংপুরের পীরগঞ্জে একটি গ্রামের সকল বাড়ীতে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নি সংযােগ করে পুড়িয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হয়েছে। পড়নের কাপড় ছাড়া তাদের কিছুই ছিল না। এছাড়াও বিভিন্ন জেলায় প্রতিনিয়ত মন্দির প্রতিমা ভাংচুর চলছেই।
গত ১৩ অক্টোবর হতে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে মােট ২৫টি জেলায় আক্রমনের ঘটনা ঘটেছে। গতকালও বরিশালের বামনাকাঠীতে প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে।
হিন্দু মহাজোটের পরিদর্শন টীম ঘটনাস্থল সমুহ পরিদর্শন করে বুঝতে পেরেছেন সম্পূর্ণ ঘটনাটি পরিকল্পিত এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণােদিত। তারা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে।
পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন স্থানে দুষ্কৃিতিকারীরা এটাকে উপজীব্য করে একর পর এক ঘটনা ঘটিয়েই চলছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনায় হিন্দু মহাজোটের পরিদর্শক দল নিম্নোক্ত ক্ষয় ক্ষতি লক্ষ্য করেছেন। ঘটনা সমূহে মােট নিহত হয়েছেন ৫ জন হিন্দু। ধর্ষনের শিকার ৫ জন, ৫ জনকে ধর্ষনের চেষ্টা করা হয়েছে।
৪০০ জনেরও অধিক মহিলাকে লাঞ্চিত করা হয়েছে। সারাদেশে আহত হয়েছেন ৬১১ জন। ৩১টি মন্দির আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে। পুজা মন্ডপ ভাংচুর করা হয়েছে ২২৭ টি। অগ্নি সংযােগ করে ভস্মীভূত করা হয়েছে ২৪১ বাড়ী। হিন্দু বাড়ীঘরে হামলা হয়েছে ৭৪৭টি। প্রতিমা ভাংচুর ও আগুনে ভষ্মিভূত করা হয়েছে ৯৯৪ টি। দোকান ভাংচুর লুঠপাট ৩১টি।
এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৭ জন হিন্দুকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। ১১ হাজার ৫০৭ টি পরিবার। নিরাপত্তাহীনতায় আছে। মােট ক্ষতি প্রায় ৩৮ কোটি টাকা।
বর্তমানে ডিজিটাল যুগ। কোন ঘটনাই কোন নির্দিষ্ট সীমানা ও দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না।বাংলাদেশে ঘটনার রেশ ধরে দেশের সীমানা পেড়িয়ে ভারত সহ সারা পৃথিবীতে এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও ব্যপক মিছিল মিটিং ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা শুনেছি সেখানেও প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে বেশকিছু মসজিদ ভাংচুর করা হয়েছে, তিনটি মসজিদে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মুসলিমদের ঘরবাড়ী দোকানপাটে হামলা, ভাংচুর ও লুঠপাটের ঘটনা ঘটেছে। আমরা এ ন্যাক্কারজনক ঘটনায় ব্যথিত এবং নিন্দা জানাই।
১৯৯১ সালে নির্বাচন পরবর্তী দেশের দক্ষিনাঞ্চলে ব্যপকভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা লুঠপাট হয় । তৎকালীন সরকার সে ঘটনার কোন বিচার করে নাই। এরপর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর চট্টগ্রামের রাউজান ফটিকছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নাসির নগর, যশােরের অভয়নগর, কুমিল্লা, সুনামগঞ্জের শাল্লা, সাতক্ষীরা, কক্সবাজারের রামু, দিনাজপুর সহ সারাদেশে কিছু সময়ের ব্যবধানে পরিকল্পিত হামলা, খুন, হত্যা প্রচেষ্টা, অগ্নিসংযােগ, ভাংচুর চালিয়ে হিন্দুদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। ফলে স্বাধীনতার প্রাক্কালে ২২% হিন্দু থাকলেও বর্তমানে তা সরকারী হিসাবে ১১.৮% এ নেমে এসেছে।
হিন্দু ধর্ম নিয়ে প্রতিনিয়ত নানা কটুক্তি ও বিদ্বেষ ছড়ানাে হচ্ছে; জবাব দিতে গেলে আইসিটিএ্যাক্টে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানাে হচ্ছে।
কুমিল্লা, হাজীগঞ্জ, নােয়াখালী, রংপুর সহ সাম্প্রতিককালে ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ১৭ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হয়ে জেল হাজতে আছে। হিন্দু ধর্ম নিয়ে প্রতিনিয়ত কটুক্তি করলেও আজ পর্যন্ত হিন্দু ধর্ম অবমাননার অভিযােগে কোন মামলা হয় নাই, কাউকে গ্রেফতার করে নাই। অতীতের সকল ঘটনাতেই সরকার অপরাধীদের গ্রেফতার ও বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে অপরাধীরা অপরাধ করতে আরও উৎসাহিত হচ্ছে। হিন্দুদের জনজীবন দিন দিন অসহনীয় ও দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। হিন্দু সমুসলিমের মধ্যে প্রীতির বন্ধন বিরাজমান। গুটি কয়েক স্বার্থান্বেসী রাজনৈতিক ব্যক্তি ছাড়া দেশের বেশীরভাগ মানুষ অসাম্প্রদায়িক । কিন্তু এই গুটিকয়েক দুষ্ট মানষিকতার রাজনীতিকরাই বিভিন্ন সময়ে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বার বার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা চালাচ্ছে। এতে করে হিন্দু সম্প্রদায়ই শুধু বার বার নির্যাতিত হচ্ছে না; বিশ্বে দেশের ভাবমুর্তিও ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। বিদেশেও বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমুর্তি নষ্ট হচ্ছে। সেকারনে দেশের ভাবমুর্তি উজ্জ্বল করতে এবং দুষ্ট রাজনীতিকদের হাত থেকে হিন্দু সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন ও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পূর্ণবহাল এবং একটি সংখ্যালঘু মন্ত্রনালয় প্রতিষ্ঠাই সংখ্যালঘু সমস্যার একমাত্র সমাধান।