আমাদের কথা ডেস্ক :
গ্রামীণফোনের আমদানি পণ্য ছাড়করণে কঠোর অবস্থান নিয়েছে দেশের সব শুল্ক স্টেশন। টেলিযোগাযোগ পণ্য আমদানিতে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে দফায় দফায় রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ ওঠায় এ রকম কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকা কাস্টম হাউস সূত্রে জানা গেছে গত দুই বছর ধরে গ্রামীণফোনের সব ধরনের পণ্য আমদানিতে তাদের ওপর কঠোর কড়াকড়ি রয়েছে। এর আগে দেশের সবগুলো শুল্ক স্টেশন থেকে গ্রামীণফোনের আমদানি পণ্য ছাড় করানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে নানা চেষ্টা-তদবির করে সে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করা হলেও এখনও সবগুলো স্টেশনে রেড অ্যালার্ট জারি করা আছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্রে জানা গেছে, আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ফাঁকি দেয়া রাজস্ব পরিশোধে একাধিকবার দাবিনামা জারি করা হলেও তাতে সাড়া দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। এ পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে শুল্ক আইনের ২০২ ধারা জারি করা হয়। ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার লুৎফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, যারাই শুল্ক ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে। এজন্য সব স্টেশনে রেড অ্যালার্ট রয়েছে। গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে যদি কোনো শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।
জানা গেছে, রাজস্ব ফাঁকি সংক্রান্ত এ বিষয়ে চলতি বছরের প্রথমদিকে গ্রামীণফোনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর একটি চিঠি পাঠায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। চিঠিতে বলা হয়, গত মার্চে গ্রামীণফোনের আমদানি করা একটি চালানের (সি-২৬৭৫৭) এইচএস কোড বদলে শুল্কায়ন করা হয়। চালানটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করে নেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট (বিল অব এন্ট্রি খালাস-উত্তর নিরীক্ষা) করে দেখা যায়, এতে ১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার ৪০৭ টাকার শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত মে মাস থেকে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে একাধিক কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়াসহ ফাঁকি দেয়া রাজস্ব ও জরিমানা মিলে প্রায় ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ট্রেজারি শাখায় জমা দিতে দাবিনামা জারি করা হয়। কিন্তু এতে সাড়া না দেয়ায় গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে ২০২ ধারা জারির মাধ্যমে দেশের সবগুলো শুল্ক স্টেশন দিয়ে পণ্য ছাড়করণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একজন অতিরিক্ত কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফাঁকি দেয়া রাজস্ব আদায়ে গ্রামীণফোনকে একাধিকবার দাবিনামাসংবলিত চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না মেলায় শুল্ক আইনের ২০২ ধারা জারি করা হয়েছে। এখন থেকে দেশের কোনো শুল্ক স্টেশন দিয়েই আমদানিকৃত পণ্য ছাড়িয়ে নিতে পারবে না প্রতিষ্ঠানটি।
আমদানি নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গ্রামীণফোন লিমিটেডের নামে আসা পণ্যের একটি চালান (সি-২৬৭৫৭) খালাসের উদ্দেশে ৯ মার্চ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দলিলাদি দাখিল করা হয়। এতে পণ্য হিসেবে ডিসি ভেন্টিলেশন সিস্টেম ফর মোবাইল ইন্ডাস্ট্রি ঘোষণা দিয়ে এইচএস কোড ৮৪১৪.৫৯.২০ (শুল্ক-৩ ও এটিভি ৪ শতাংশ) শ্রেণীবিন্যাস করে শুল্কায়ন করা হয় এবং বন্দর থেকে তা ছাড়িয়েও নেয়া হয়। শুল্ক কর্তৃপক্ষ পরে চালানটিতে বিল অব এন্ট্রি খালাস-উত্তর নিরীক্ষা করে। তাতে দেখা যায়, আমদানি পণ্য এইচএস কোড ৮৪১৪.৫৯.৯০ (শুল্কহার ২৫%+ ৫%+১৫%+ অন্যান্য করাদি) শ্রেণীবিন্যাসযোগ্য। পণ্যের চালানটি পুনরায় শুল্কায়ন করে ফাঁকি দেয়া রাজস্ব নির্ধারণ করা হয় ১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার ৪০৭ টাকা। এর সঙ্গে জরিমানা নির্ধারণ করা হয় আরও ১০ লাখ টাকা।
প্রসঙ্গত, এর আগেও টেলিযোগাযোগ পণ্য আমদানিতে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে কয়েক দফা শুল্ক ফাঁকির ঘটনা উদঘাটন করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। উচ্চ শুল্কের এইচএস কোডের পণ্য নিু শুল্কের এইচএস কোডে আমদানির অভিযোগে তখনও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দাবিনামা জারি করা হয়। কিন্তু প্রতিবারই তারা দাবিনামার বিপরীতে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে।
এর আগেও একবার আমদানি করা হার্ডওয়্যার ফর বেইজ স্টেশন কন্ট্রোলার ৬৯০০ (টেলিকমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি) চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড়িয়ে নেয় গ্রামীণফোন লিমিটেড। অথচ আমদানি দলিলাদিতে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল কম শুল্কের টেলিগ্রাফিক স্যুইচিং অ্যাপারেটাস। পরে চালানটির পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট করে দেখা যায়, প্রকৃত এইচএস কোডে শুল্কায়ন না করে তাতে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকার শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়েছে।
ওই বছর আমদানি করা আরেকটি চালানে (সি-৮৬৯২৮) ট্রান্সমিটিং অ্যান্ড রিসিভিং অ্যাপারেটাসকে প্রকৃত এইচএস কোডে শুল্কায়ন না করায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়। এইচএস কোড ৮৫১৭.৬২.১০-এর ঘোষণা দিয়ে মাত্র ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা রাজস্ব পরিশোধ করেই সে সময় চালানটি ছাড় করিয়ে নেয় গ্রামীণফোন। যদিও আমদানি করা এ পণ্যের প্রকৃত এইচএস কোড ৮৫১৭.৬২.৯০।
একইভাবে ওই বছর টেলিকমিউনিকেশন যন্ত্রপাতির অন্য একটি চালানে (সি-৫৯৬৩৫) ফাঁকি দেয়া হয় ৫ কোটি ৪২ লাখ ৭ হাজার টাকা। ওই রাজস্ব পরিশোধে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে দাবিনামাও জারি করে শুল্ক কর্তৃপক্ষ। পণ্যের চালানটিতে মাত্র ১ কোটি ৭৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকার রাজস্ব পরিশোধ করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাস করে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। শুধু চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস নয়, ঢাকা কাস্টম হাউসেও বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ আছে।