আমরা সময়ের কথা সময়ে বলি।

Advertisement

জলপাই জঙ্গলের সাগর, রুনি ও মেঘ

মুক্তমত 16 February 2019 ৭২৯

প্রায় বিশ বছর আগের কথা। গ্রাম থেকে সবে ঢাকায় এসেছি। শুরু করেছি সাংবাদিকতা। অফিস ৬৮/২ পুরানা পল্টন। পত্রিকার নাম ‘চলতিপত্র’। সুধী সমাজে এর সুনাম আছে। কাটতিও মন্দ নয়। ‘যায়যায়দিনের’ প্রতিপক্ষ এটি। গাজী শাহাবুদ্দীনের পাক্ষিক ‘সচিত্র সন্ধানী’ ও সন্ধানী প্রকাশনী’র খানিকটা জায়গা জুড়ে চলত চলতিপত্রের কাজকর্ম। সেই সুবাদে সন্ধানী প্রকাশনীর ম্যানেজার তপন মাহমুদের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং একপর্যায়ে তা বন্ধুত্বে রূপ নেয়। একসময় সচিত্র সন্ধানী ছিল সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সেরা কাগজ। বহু লেখক-সাংবাদিকের জন্ম দিয়েছে এই সচিত্র সন্ধানী পত্রিকা। সন্ধানী প্রকাশনী এদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী এবং স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে বহু ভালো বই প্রকাশ হয়েছে। শওকত ওসমানের ‘কৃতদাসের হাসি’, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’, আবদুল গাফফার চৌধুরীর সর্বনাশের আশায়, সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’সহ আরো বেশকিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। সচিত্র সন্ধানী বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। তখন চলছে সন্ধানী প্রকাশনী বন্ধের আয়োজন। তাই তপন মাহমুদ এখন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ‘বিজয় প্রকাশ’ নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এজন্য এখন তিনি ব্যস্ত পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের কাজে। সাপ্তাহিক চলতিপত্র বন্ধ হওয়ার পর আমি প্রতিদিন সকালে সচিত্র সন্ধানী অফিসে আসি। তপনের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা দেই। একদিন গ্রীষ্মের অলস দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সন্ধানী প্রকাশনীর অফিসে গাজী শাহাবুদ্দিনের রুমে সোফায় শুয়ে আছি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ, চোখজুড়ে ঘুমের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র চলছে। এরই মধ্যে গ্রামের কথা, গ্রামের বন্ধু-বান্ধব পরিচিত জনদের কথা খুব মনে পড়ছে। তন্দ্রায় চলে গেছি। মনে হচ্ছে আমি যেন শুয়ে আছি গ্রামের বাড়ির কাঠের দোতলায়। বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে আম, জাম, কদম, নারিকেল ও হিজল গাছ। এরই কোনো একটি গাছে বসে রৌদ্রশ্রান্ত একটি ঘুঘু খুব আয়েশী ভঙ্গিতে একনাগাড়ে ডেকে চলেছে। এই ঘুঘুর ডাকে কিছুক্ষণ পর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখি আমার পার্শ্ববর্তী গ্রামের বড়ভাই আমাকে ডাকছেন। পেশায় তিনি সাংবাদিক, নাম সাগর সারোয়ার। সঙ্গে তার বান্ধবী। নাম মেহেরুন রুনি। দু’জনেই দৈনিক সংবাদে কর্মরত। সাগর ভাই এক সময় চলতিপত্রে লিখতেন। সেই সূত্রে তার সঙ্গে পরিচয়। পরে তার কাছেই জানতে পারি তিনি আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ, আমাদের পাশের গ্রামেই তার বাড়ি। তবে গ্রামের বাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ কম, নেই বললেই চলে। সাগর ভাই ফর্সা, লম্বা ও সুদর্শন। অনেক দিক দিয়েই অসাধারণ তিনি। ব্যক্তিত্বে, আচরণে, সংযমে নিজ বৃত্তের সব মানুষের চেয়ে অনেক উন্নত। বিশেষভাবে ব্যতিক্রমী তার আন্তরিকতা। বন্ধু ও ছোট ভাইদের ব্যাপারে খুব আন্তরিক তিনি। প্রতারণা ও প্রহসন তার স্বভাবে নেই। আচার-আচরণে, চিন্তা ও চেতনায় স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন। কথাবার্তা, চলাফেরা ও পোশাক-পরিচ্ছদে আছে রুচির ছাপ। অতিশয় সভ্য, শান্ত, ভদ্র ও বিনয়ী। সহজে কারো সঙ্গে তর্ক ও বিবাদে জড়ান না। কখনো কোনো বিষয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মতান্তর হলেও তা কোনোক্রমেই বিরোধে পরিণত হয় না। নির্লোভ মানুষ তিনি। অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, যশ, সম্মান এসব কিছুর প্রতি তার বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই। তার চারপাশে শঠ, তঞ্চক ও প্রবঞ্চকদের বিস্তর আনাগোনা আছে বৈকি। কিন্তু ওইসব মানুষের দীনতা, লোভ, ইতরতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। একেবারেই অন্যরকম মানুষ সাগর ভাই। আর মেহেরুন রুনি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা একটি মিষ্টি মেয়ে। তার চোখেমুখে সব সময় এক চিলতে হাসি লেগে থাকে। এই হাসির নানা রকম মানে হয়। সাগর ভাই এবং রুনির মধ্যে প্রেম চলছে। বিয়ের কথাবার্তা প্রায় ঠিকঠাক। এখানে আমাকে দেখেই সাগর ভাই জানতে চাইলেন আমি কেমন আছি, কেমন চলছে আমার দিনকাল। উত্তরে আমি বললাম, এই তো আছি এক রকম, বেকারত্ব উপভোগ করছি। পাশাপাশি চাকরি খুঁজছি। কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে, আশ্বাসও পেয়েছি। এই আশ্বাস পাওয়ার কথাটা সত্যি নয়। সাগর ভাই বড় সাংবাদিক, আমার এলাকার বড় ভাই। তিনি যেন না ভাবেন আমি তার কাছে নিজের চাকরির তদবির করছি। এর চেয়েও বড় কথা, তার সুন্দরী মেয়েবন্ধুটি যাতে না ভাবে আমি একটা অকম্মার ঢেকি! সে কারণেই কথাটা বললাম। সাগর ভাই একটু ভেবেচিন্তে বললেন, তোমার মতো উপযুক্ত লোকের চাকরি পেতে খুব একটা সময় লাগবে না। যাক, তোমাকে পেয়ে ভালোই হলো। আমার একটা কথা আছে। আমি একটি কিশোর উপন্যাস লিখেছি। বিজয় প্রকাশ থেকেই এটা বেরুব। তুমি এর সম্পাদনা ও প্রুফ দেখার দায়িত্বটা নিলে আমি চিন্তামুক্ত হই। তোমার এখন অফুরন্ত অবসর। বিনাকাজে বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা করা ভালো, আমার কাজটা করো। এতে তোমার সময়টা একটু ব্যস্ততার মধ্যে কাটল, আমার কাজটাও হলো, আবার বেকার জীবনে তোমার কিছু আয়ও হলো- মন্দ কি! তার এই প্রস্তাবে আমি নিশ্চুপ থাকায় তিনি বললেন, না করো না ভাই। এটা আমার প্রথম বই। আমি চাই এটা একটু নির্ভুলভাবে বের হোক। আমি রাজি হলাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে পাণ্ডুলিপি বুঝিয়ে দিলেন, সঙ্গে অগ্রিম এক হাজার টাকা। বইটির নাম ‘জলপাই জঙ্গলে’। এর নায়কের নাম ‘মেঘ’। আমি যথারীতি বইটি দেখে দেই। ওই বছরই বইমেলায় বইটি বের হয়। এরপর সাগর-রুনির সঙ্গে আমি কোনো যোগাযোগ রাখিনি। কয়েক বছর পর শুনলাম তাদের বিয়ে হয়েছে। একটি ছেলেও হয়েছে। ছেলেটির নাম রেখেছে ‘মেঘ’। নামটা শুনে খুব ভালো লাগল, জলপাই জঙ্গলের সেই ‘মেঘ’! ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বইমেলার শিশুপ্রহরে প্রথমবারের মতো মেঘের সঙ্গে দেখা। মা-বাবার সঙ্গে বইমেলায় এসেছিল মেঘ। আমার সঙ্গে ছিল পদ্য (আমার মেয়ে)। আমরা পাঁচজন মেলার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ালাম। এর কয়েক দিন পর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ঘুম থেকে উঠে টিভি অন করতেই দেখি সাগর-রুনি দম্পতির মৃত্যু সংবাদ। এ সংবাদ তখন আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আজও বিশ্বাস হয় না…

লেখক: সাংবাদিক