
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত; বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রাণপুরুষ! জাতীয় পতাকার মূল রূপকার শিবনারায়ণ দাসের মতো স্যার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকেও স্বাধীন বাংলার মাটিতে খুব একটা পরিচিত করানো হয় নি। হয়তো সংখ্যালঘু হিন্দু বলেই! . পাকিস্তান গণপরিষদে যিনি প্রথম মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদার দাবি তুলে ধরেছিলেন, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত যিনি স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন তিনি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। . বলা যেতে পারে একুশের গোড়ায় ছিলেন কুমিল্লার কৃতিসন্তান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। আমরা মায়ের ভাষায় প্রাণখুলে কথা বলতে পারছি যে সকল কালজয়ী মহান ব্যক্তির অক্লান্ত ত্যাগের কল্যাণে; তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। . ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তরে রামরাইল গ্রামে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম। ছেলেবেলা থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকলেও রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি হয় ১৯০৫ সালের পর বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার দাবি গণপরিষদে উত্থাপনে তিনি পূর্ব বাংলায় ‘বীরের মর্যাদা’ পান। . ধীরেন দত্ত তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং কারাগারে আটক ছিলেন। ১৯৩৫ সালের নতুন ভারত শাসন আইনে ১৯৩৭ সালে যে সাধারণ নির্বাচন হয়, তাতে জয়লাভ করে তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনেও তিনি আবার নির্বাচিত হন। . দেশ ভাগের পর তিনি পাকিস্তান সংবিধান সভার সদস্য হিসেবে করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রথম অধিবেশনে যোগদান করেন এবং তৎকালীন পূর্ব বাংলায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৭ সালে গঠিত সংবিধান সভা একই সঙ্গে পাকিস্তান গণপরিষদ হিসেবেও কাজ করে। ওই গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন করাচিতে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। . পাকিস্তান গণপরিষদের এ অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই পূর্ব বাংলায় বাংলাকে অফিস-আদালতের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার জন্য ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনেরই প্রতিফলন ঘটে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত ভাষা বিষয়ক একটি প্রস্তাবের মধ্যে। প্রস্তাবটিতে তিনি বলেন, ‘উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের অধিকার থাকতে হবে’। . তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন, পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের ছয় কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে চার কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী। সুতরাং বিষয়টিকে প্রাদেশিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাংলাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে দেখা উচিত। তাই তিনি গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্তির দাবি করেন। . ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটি পাকিস্তান গণপরিষদে আলোচিত হয় ১৯৪৮’র ২৫ ফেব্রুয়ারি। প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, মোহাজের ও পুনর্বাসনমন্ত্রী গজনফর আলী খান, পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন এবং গণপরিষদের সহ-সভাপতি তমিজউদ্দিন খান। . প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তার বক্তৃতায় বলেন, ‘পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা ও একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।’ খাজা নাজিমুদ্দীন বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব, ‘একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্র ভাষারূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।’ . মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের নেতাদের এসব বক্তব্যের জবাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব সমর্থন করে গণপরিষদে কংগ্রেস দলের সেক্রেটারি রাজকুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশেরই কথ্য ভাষা নয়। তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপরতলার কিছুসংখ্যক মানুষের ভাষা। আসলে এ হলো অন্যদের উপর উচ্চশ্রেণির আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা। বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্য চাপ দিচ্ছি না। আমরা শুধু চাই পরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি। ইংরেজিকে যদি সে মর্যাদা দেয়া হয়, তাহলে বাংলা ভাষাও সে মর্যাদার অধিকারী।’ ১১ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা উর্দু বিল পাশ হয়ে যায়। . ওই দিন সারা পূর্ব বাংলায় প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত করাচীর অধিবেশন থেকে ঢাকায় ফিরে এলে, বিমান বন্দরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা তাকে বিপুল সম্বর্ধনা জানান। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত মূলতঃ সেখান থেকেই। . ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের অধিবেশনের ঠিক আগে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ কয়েকজন পরিষদ সদস্যকে ছাত্ররা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ভেতরে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের দ্বারা আক্রান্ত কয়েকজনের কাছে নিয়ে যান এবং পরিষদের বাংলা ভাষার সপক্ষে বলার জন্য তাদের কাছে দাবি জানান। . পরদিন সরকার সমর্থক ইংরেজি দৈনিক ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় এর একটি মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে বলা হয়, পরিষদ অধিবেশনের আগে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের কাছে গিয়ে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং ছাত্ররা ১০ জন করে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে শুরু করেন। এ মিথ্যা প্রচার সম্পর্কে পরিষদের অধিবেশনে ধীরেন দত্ত প্রতিবাদ করে নিজের বক্তব্য দেয়ার অনুমতি চান। কিন্তু স্পিকার সে অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন এ যুক্তিতে যে, ওই ধরনের প্রচারণার সঙ্গে পরিষদের কোনো সম্পর্ক নেই। . শুধু ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সমগ্র পর্যায়টিতে পরিষদের অভ্যন্তরে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষার সপক্ষে এবং ছাত্র ও সাধারণ মানুষের ওপর সরকারি নির্যাতনের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তৃতা করেন। . এত অক্লান্ত ত্যাগের পরও বাংলাভাষার এই প্রথম প্রাণপুরুষ স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই বর্বর পাক হানাদার বাহিনী যে নির্মম গণহত্যা শুরু করে, তিনি তার শিকার হন। তাকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যা