রিপন চৌধূরী।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ নিজ জন্মভুমিতে অবহেলিত, উপেক্ষিত!
স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণের বদলে যেন মুছে দেয়ার পরিকল্পনা! ্সরোদ’ নামক বাদ্যযন্ত্রটির কিংবদন্তী কালাকার, বিশ্বের সঙ্গীত জগতে ‘সুরসম্রাট’ হিসেবে পরিচিত, বিশ্বখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর আজ (৬ সেপ্টেম্বর) ৪৭-তম মৃত্যুবার্ষিকী।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে জন্ম নেয়া সঙ্গীতের এই বরপুত্র আজকের দিনে ভারতের মাইহারে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর প্রায় অর্ধ শতক পরও ওস্তাদজীর জন্মভুমিতে তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্নগুলো সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। নিজ জন্মভুমিতে সঙ্গীতের এই কিংবদন্তী ও তাঁর পরিবার যেন এখনও অবহেলিত, উপেক্ষিত।
নবীনগর উপজেলা সদর থেকে মাত্র সাত কি.মি. পূর্বদিকে অবস্থিত শিবপুর নামক গ্রামটিতে এখনও যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই নাজুক। গত মঙ্গলবার সঙ্গীতের তীর্থভুমি খ্যাত ‘শিবপুর’ গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে কথা বলে সঙ্গীতের এই কিংবদন্তী ‘সুরসম্রাট’ তাঁর নিজের পূণ্যভুমিতে এখনও কতটা অবহেলিত ও উপেক্ষিত সেটি জানা গেল।
অথচ এই অজ পাড়া গ্রামটিতেই বিশ্বখ্যাত সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, তার ছোট ভাই সুরসাধক ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, বড় ভাই ‘মলয়া’ গানের সুরস্রষ্টা ফকির তাপস আফতাব উদ্দিন খাঁসহ আজকের প্রখ্যাত সুরকার শেখ সাদী খান, রাজা হোসেন খান, সরোদ শিল্পী ওস্তাদ শাহাদাৎ হোসেন খানসহ বহু সঙ্গীত সাধক ও কালাকার জন্ম গ্রহণ করেছেন।
তবে সঙ্গীত জগতের অহংকার এই ওস্তাদ পরিবারটি তাঁর জন্মভূমিতে কতটা অবহেলিত কিংবা উপেক্ষিত তার সর্বশেষ উদাহরণ হলো শিবপুরের যেই বাড়িতে বিশ্বসেরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বড় বড় গুণী শিল্পীরা জন্ম নিয়ে পুরো গ্রামটিকে তথা বাংলাদেশকে বিশ্বের সঙ্গীত দরবারে ব্যাপকভাবে পরিচিতি দিয়েছেন, আজ সেই সঙ্গীত পরিবারের ‘ঐতিহাসিক’ বাড়িটি সরকার রাস্তা করার জন্য সহসাই অধিগ্রহণ (এ্যাকুয়ার) করে নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ওস্তাদ পরিবারের সদস্যরা।
সরজমিনে দেখা যায়, বর্তমানে বাড়িটিতে সপরিবারে অনেকটা দীনতার মধ্য দিয়ে বসবাস করেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বড় ভাই ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর মেয়ের বংশধর ইদ্রিস খান।
৬২ বছর বয়স্ক আট সন্তানের জনক ইদ্রিস খান বললেন,‘কয়েকদিন আগে সরকারি লোক আইস্যা আমারে একটা ‘নেটিশ’ দিয়া গেছে। আর কইয়া গেছে, এই বাড়ির সব কাগজপত্র ঠিক ঠাক কইরা রাখতাম। কারণ তিনশ ফিটের যেই বড় রাস্তা সরকার আগামিতে বানাইব, হেই রাস্তাডা নাকি এই বাড়ির বেশীর ভাগ জায়গার উপর দিয়াই যাইব।’
ইদ্রসি খান বাড়ির উত্তর পূর্বকোণে দুটি অরক্ষিত কবর দেখিয়ে দু:খ করে আরও জানালেন, সুরসম্রাটের বাবা সবদর হোসেন খাঁ (সদু খাঁ) ও মাতা সুন্দরী খানমের শত বছরের পুরানো বিধ্বস্থ ওই দুটি কবরই এখন এই ঐতিহাসিক বাড়িটিতে ওস্তাদ পরিবারের সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন। বাড়ির উপর দিয়ে বিশাল রাস্তা তৈরী হলে এই শেষ স্মৃতি চিহ্নটুকুও শেষ হয়ে যাবে।’
পরে বিষয়টি নিয়ে কথা হয়, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র, একুশে পদকসহ বহু জাতীয় পুরস্কারে ভুষিত, দেশের অন্যতম জনপ্রিয় সুরকার শেখ সাদী খানের সঙ্গে। সুরের এ যাদুকর শেখ সাদী বলেন,‘এবার বুঝুন ভাই, এই সঙ্গীত পরিবারটি আজ সত্যিই কতটা অবহেলিত ও উপেক্ষিত। তাই আমি সঙ্গীত জগতের দুই দিকপাল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর (শেখ সাদী খানের বাবা) স্মৃতিধন্য এই ঐতিহাসিক বাড়িটি রক্ষার্থে তিনশ ফিটের ওই প্রস্তাবিত রাস্তাটি যেন বাড়িটিকে রক্ষা করে তৈরী করা হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে সঙ্গীত পরিবারটির পক্ষ থেকে এটি আমাদের সকলের কড়জোরে প্রণতি।’
কথা হয়, শিবপুরে চার দশকেরও বেশী সময় ধরে ‘সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি সংসদ’ নামে একটি সংগঠন করে যিনি নতুন প্রজন্মের কাছে এখনও ওস্তাদ পরিবারটিকে সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত রাখার জন্য একাগ্রচিত্তে কাজ করে যাচ্ছেন, সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, এলাকার কৃষকলীগ নেতা রানা শামীম রতনের সঙ্গে। রানা শামীম বলেন,‘শুনেছি, এটি নাকি একটি আন্তর্জাতিক সড়ক হবে। সুতরাং রাস্তা আমরাও চাই। কিন্তু ওস্তাদ পরিবারের এই ঐতিহাসিক বাড়িটিকে ধ্বংস করে কেন এটি করতে হবে? বাড়িটিকে রক্ষা করেই যেন সড়কটি নির্মাণ করা হয়, সেই দাবি আমাদেরও।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক প্রবীণ সাংবাদিক জানালেন,‘শিবপুরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর রেখে যাওয়া প্রাচীন একটি মসজিদ, বড় ভাই আফতাব উদ্দিন খাঁর মাজার, সুরসম্রাটের বাবা মার কবর ও তাঁর পৈত্রিক ঐতিহাসিক বাড়িটিসহ ওস্তাদজীর রেখে যাওয়া কোন স্মৃতি চিহ্নই এখন পর্যন্ত সংরক্ষণে তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সেখানে নতুন করে রাস্তা তৈরীর নামে ওস্তাদ পরিবারের পূণ্যভুমি খ্যাত এই বাড়িটিকে ধ্বংস করার সরকারি এই পরিকল্পনা কোন ভাবেই মেনে নেয়া হবেনা।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামীলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক, নবীনগরের সন্তান এডভোকেট শিব শংকর দাস বলেন,‘সঙ্গীতের তিন দিকপাল হাসন রাজা, বাউল আবদুল করিম ও লালন শাহ্’র স্মৃতিকে ধরে রাখতে সিলেট ও কুষ্টিয়ায় সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও, যিনি শাস্ত্রীয় মার্গীয় সঙ্গীতকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরে বাংলাদেশকে সুউচ্চ আসনে বসিয়ে গেছেন, সেই সুরের রাজা সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে তাঁর জন্মভুমিতে (শিবপুর) এখও কিছু আমরা করতে পারিনি, এটি সত্যিই লজ্জার, বড়ই দুর্ভাগ্যের। তাই শিবপুরে সরকারের নেয়া সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নামে বিগ বাজেটের ‘কালচারাল মিউজিয়াম’ তৈরীর প্রকল্পটি অবিলম্বে বাস্তবায়নের আমি জোর দাবি করছি।’
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও তথ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সদস্য এবাদুল করিম বুলবুল বলেন,‘ইনশাল্লাহ এ সরকারের আমলেই ওস্তাদজীর স্মৃতিচিহ্নগুলোকে সংরক্ষণের জন্য শিবপুরে ওস্তাদজীর নামে সরকারের নেয়া ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ কালচারাল কমপ্লেক্স’ নির্মাণের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। পাশাপাশি ওস্তাদজীর ঐতিহাসিক এই বাড়িটিকে বাঁচিয়ে কিভাবে আন্তর্জাতিক ওই রাস্তাটি করা যায়, সেটি নিয়েও সংশ্লিষ্টদের সাথে প্রয়োজনে একাধিকবার বৈঠকে বসবো।’
Copyright © 2023 Amaderkatha | Design & Developed By: Design Ghor