বেপরোয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী ইমতিয়াজ আহমেদ

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ : ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ ৪১৭

ব্রাক্ষনবাড়িয়া।।

শ্বশুরবাড়িতে জামাই। বেড়াতে নয়, চাকরির সুবাদে এসেছেন এখানে। তবে সরকারি আবাসস্থল ফেলে থাকছেন শ্বশুরবাড়িতেই। আর সে কারণেই বেপরোয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী ইমতিয়াজ আহমেদ। থ্রি পার্সেন্ট হিসাবেও নাম ছড়িয়ে পড়েছে তার। আছে আরো নানা অভিযোগ। জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় যোগদানেও অনীহা এই কর্মকর্তার। নিজের কর্মস্থলেও আসেন বেলা করে। ইমতিয়াজ আহমেদ গত বছরের ৭ই অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যোগ দেন। এরপর থেকেই বিশেষ কয়েকজন ঠিকাদার হয়ে উঠে তার সঙ্গী।

অফিসে তার কক্ষে ওই ঠিকাদাররা ছাড়া অন্য কারো প্রবেশও সহজসাধ্য নয়। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় সাধারণ ঠিকাদারদের। কাজে দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি, পার্সেন্টেজ বাণিজ্য, শিডিউল ফাঁসের নানা অভিযোগ উঠেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া গণপূর্ত বিভাগের বিরুদ্ধে। কোটেশন, ভাউচারে কাজ করিয়েও লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দেয়া, প্রত্যেক কাজ থেকে ৩ পার্সেন্ট বা তারো বেশি অঙ্কের ঘুষ নেয়ার অভিযোগ নির্বাহী প্রকৌশলী ইমতিয়াজ আহমেদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে আলোচিত। ঠিকাদাররা বলেন- অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার সময় ব্যাগ ভরে টাকা নিয়ে যান তিনি।

জেলায় চলমান ১৫/২০টি প্রকল্পের কাজের অধিকাংশই করছে তার পছন্দের ঠিকাদাররা। পনের’শ কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগে হালে আলোচিত গণপূর্তের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সুপারিশে তার আত্মীয়-স্বজনকেও কাজ দিয়েছেন ইমতিয়াজ। রফিকুল ইসলামের বাড়ি নবীনগরের রসুল্লাবাদ গ্রামে। সেখানকার সব কাজই করছেন রফিকুলের আত্মীয়স্বজন। সর্বশেষ নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর, আশুগঞ্জ ও আখাউড়া উপজেলা ভূমি অফিস নির্মাণ কাজও পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। মেসার্স মোখলেছ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. মোখলেছুর রহমান জানান, আশুগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিস নির্মাণ কাজের জন্য যে প্রাক্কলন মূল্য (অফিসিয়াল কস্ট ইস্টিমেট) নির্ধারণ করা হয়েছে সেই অনুসারে কাজের সর্বনিম্ন দরদাতা তিনি। কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলী সুবিধার বিনিময়ে এই মূল্য ফাঁস করে তার পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেয়ার রাস্তা বের করেছেন। মোখলেছুর রহমান মেসার্স মোস্তফা কামালের নামে এই দরপত্রে অংশ নেন। এখন কাজটি দেয়া হচ্ছে নির্মাণ বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। অন্য তিন উপজেলায় কোনো ঝুটঝামেলা ছাড়াই তার পছন্দের ঠিকাদাররা কাজ পেয়েছেন। আখাউড়া ও বাঞ্ছারামপুরে কাজ পেয়েছেন মেসার্স মোস্তফা কামাল নামের একই প্রতিষ্ঠান। সেখানে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান দরপত্রেই অংশগ্রহণ করেনি। নবীনগরের কাজটি দেয়া হয়েছে আলোচিত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের এক আত্মীয়কে। জানা গেছে, ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের নামে এই কাজটি দেয়া হয়।

এই দরপত্র আহ্বানের আগেই কাজ কারা কারা পাবেন তা নির্ধারিত হয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ঠিকাদার বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলী ভেটিং ফিগার বিক্রি করে টাকা কামাচ্ছেন। ভূমির কাজের ভেটিং বিক্রি করে ৩/৪ দিনের জন্য তিনি ঢাকায় লাপাত্তা হয়ে যান। ওই ঠিকাদার আরো বলেন, জোন (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কার্যালয়) থেকে যে রেট পাস হয় সেটি আপ-ডাউন করে সে পার্সেন্টেজ নিয়ে ঠিকাদারদের কাজ দেয়। ইমতিয়াজ আহমেদ যোগদানের পর থেকে বড় বড় সব কাজ এভাবেই দু-নম্বরি করে পছন্দের ঠিকাদারদের দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন এই ঠিকাদার। জেলায় চলমান অধিকাংশ প্রকল্পের ঠিকাদারি কয়েকজনের হাতে। পার্সেন্টজ নিয়ে তাদেরকে কাজ দেয়ার অভিযোগ ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শেখ মো. আজিম ও জাহের মৃধা বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে বিজয়নগর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন নির্মাণ, সরাইলের খাটিহাতায় ৪ তলা ভিতের দ্বিতল পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণ, এনএসআই’র জেলা কার্যালয়, কসবায় মডেল মসজিদ নির্মাণের কাজ করছেন। জেলার ৩টি মডেল মসজিদের কাজ পেয়েছেন ঠিকাদার হারুনুর রশিদ হিরো। তার প্রতিষ্ঠান মেসার্স হারুনুর রশিদ আরো কয়েকটি কাজ করছেন।

শহরের মেড্ডায় সমাজসেবা ভবন নির্মাণ, আখাউড়ায় মডেল মসজিদ নির্মাণের কাজ পেয়েছে নির্মাণ বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। মোস্তফা কামাল মস্তুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কসবা সাব রেজিস্ট্রি অফিস, সদর সার্কেল অফিস, বাঞ্ছারামপুর মডেল মসজিদ নির্মাণের কাজ পেয়েছে। নাসিরনগর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস নির্মাণের কাজ করছে মেসার্স ভূঁইয়া বিল্ডার্স ও আবু জাহের মৃধার নামীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নবীনগর সার্কেলে অফিসের কাজও করছেন গণপূর্তের আলোচিত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের এক আত্মীয়। ইমতিয়াজ আহমেদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মো. জাহাঙ্গীরের মেয়ের জামাতা। এখানে যোগদান করার পর থেকেই তিনি থাকছেন শহরের টেংকেরপাড় এলাকায় তার শ্বশুরবাড়িতে। অবকাশ এলাকায় নির্বাহী প্রকৌশলীর বাসভবন ফাঁকা। আলোচনা রয়েছে এখানে যোগদান করার পর তার শ্বশুর তার দলের কিছু লোকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। অফিস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে তার দুর্ব্যবহারের অভিযোগ অনেক। তার কক্ষে ফাইল আনতে গিয়েও ধমক খেতে হয় পিয়নদের। একাধিক কর্মকর্তা বলেন, তার রুমে গিয়ে আমরাও বসতে পারি না। তারা বলেন- তার হয়তো খুঁটির জোর আছে। সে কারণেই এভাবে অফিস চালাতে পারছেন।

সে যা বলে তাই। কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। একাধিক ঠিকাদার জানান, ঠিকাদার সমিতির লোকজন এখানে যোগদান করার পর তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেন। ঠিকাদার সমিতির সভাপতি শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ওই দর্শনের সময় ‘আমরা সবাই একই ফ্যামিলির’ বলার পর নির্বাহী প্রকৌশলী তাকে বলেন-কিসের ফ্যামিলি। পছন্দের ঠিকাদার ছাড়া তার কক্ষে কেউ যেতে পারে না বলেও জানান তারা। ঠিকাদাররা আরো জানান, ২৩শে সেপ্টেম্বর গণপূর্তের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঠিকাদার সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শামসুল হক ভূঁইয়ার মৃত্যুতে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে ঠিকাদার সমিতি। নির্বাহী প্রকৌশলীকে এর নিমন্ত্রণ দিয়ে থাকার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলী ওই সময় অফিসে থাকলেও মিলাদে যোগ দেননি। হিরো নামে এক ঠিকাদারকে নিয়ে নিজের কক্ষে ব্যস্ত ছিলেন। এ নিয়ে ক্ষোভ দেখা দেয় ঠিকাদারদের মধ্যে। কাজে ব্যাঘাত হয় বলে অফিসের মসজিদের নামাজের সময়সূচিও পরিবর্তন করে দিয়েছেন এই কর্মকর্তা। সোয়া ১টার পরিবর্তে দেড়টায় নামাজ পড়তে বলে দিয়েছেন তিনি। এসব বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী ইমতিয়াজ আহমেদের বক্তব্য- এসব অভিযোগ সত্য নয়। ৩ পার্সেন্ট টাকা নেয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তিনি। ছাত্রাবস্থায় শিবিরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার বিষয়টিও ঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি।

[gs-fb-comments]
Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com