
ঢাকা।।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের দফতর সম্পাদক জনাব আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম আজ মঙ্গলবার বিকালে এক বিবৃতিতে সিপিবির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বিএলএফ-এর নেতৃবৃন্দ শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও হাসানুল হক ইনুর নাম উল্লেখ করে, ’তারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি’ বলে গতকাল তাদের দলীয় কার্যালয়ে বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় যে বক্তব্য দিয়েছেন, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা করেছেন।
জনাব কাইয়ূম বলেছেন, সিপিবির সভাপতি ‘মেধাবী মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক’ হিসাবে পরিচিত কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনীর ভূমিকা ও ব্যক্তি হিসাবে বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনীর চার আঞ্চলিক অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ এবং বিএলএফ-এর প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের কমান্ডেন্ট হাসানুল হক ইনু সম্পর্কে ব্যক্তিগত বিদ্বেষপূর্ণ যে বক্তব্য দিয়েছেন তা শুধু দুঃখজনকই নয়, তা ঐতিহাসিক সত্য ও যুদ্ধবিদ্যার সাধারণ জ্ঞান পরিপন্থী। কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তার বক্তব্যে প্রমাণ করেছেন, তিনি আওয়ামী লীগের বিরোধীতা করতে গিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিতর্কিত ও মুক্তিযুদ্ধের মহিমাকেই ম্লান করার পুরাতন কৌশলের ফাঁদেই পা দিয়েছন মাত্র।
জনাব কাইয়ূম বলেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ও চালিকা শক্তি হিসাবে মূল ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রলীগ। মুক্তিযুদ্ধে মুজিব নগরে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মূলতঃ গণবাহিনীর (মুক্তিফৌজ বা মুক্তিবাহিনী) ১১টি সেক্টর ও নৌ কমান্ডো এবং বিএলএফ-এর অন্তর্ভূক্ত হয়ে যুদ্ধ করেছেন। এর বাইরে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), ন্যাপ (মো), সিপিবির সদস্যদের পৃথকভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে গঠিত ‘ছাত্র ইউনিয়ন-ন্যাপ-সিপিবি বাহিনী’ আর ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), চিনপন্থী কমিউনিস্টদের বিভিন্ন ছোট ছোট খন্ডাংশ বা গ্রুপ এবং ভাসানী (ন্যাপ) এর ছোট ছোট খন্ডাংশ বা গ্রুপ ও কিছু ব্যক্তি পৃথকভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ নামে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এর বাইরে দেশের অভ্যন্তরেই টাঙ্গাইল অঞ্চলে কাদেরিয়া বাহিনী, টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জের কিছু অঞ্চলে বাতেন বাহিনী, সিরাজগঞ্জে লতিফ মির্জা বাহিনী, মানিকগঞ্জে লুডু বাহিনী, মাগুরা-ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়ার কিছু অঞ্চলে আকবর বাহিনী, ফরিদপুর-গোপালগঞ্জের অংশ বিশেষে হেমায়েত বাহিনীসহ অনেকগুলি আঞ্চলিক বাহিনী যুদ্ধ করেছে।
জনাব কাইয়ূম বলেন, যেহেতু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় কেবলমাত্র ছাত্রলীগই ৬০দশকের শুরু থেকেই সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সে লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তাই ২৫ মার্চের ক্র্যাক ডাউনের সাথে সাথেই দেশব্যাপী ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই প্রাথমিক প্রতিরোধের সূচনা করেন এবং বিদ্রোহী পুলিশ, ইপিআর, সেনাবাহিনীর সদস্যদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে যান। তাই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত গণবাহিনীর (মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিফৌজ) ১১টি সেক্টরে ও নৌ-কমান্ডোতেও ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের সদস্যদের অংশগ্রহণ ছিল স্বাভাবিকভাবেই বেশি। এ ছাড়া কাদেরিয়া বাহিনী, বাতেন বাহিনী, লতিফ মির্জা বাহিনী, লুডু বাহিনী, আকবর বাহিনী, হেমায়েত বাহিনীসহ আঞ্চলিক বাহিনীগুলোতেও ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের সদস্যদের অংশগ্রহণের আধিক্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘ মেয়াদি হতে পারে এই ধারনা থেকেই দীর্ঘমেয়াদী প্রলম্বিত গেরিলা যুদ্ধ ও গণযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষিত গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের বাঁছাই করা নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠন করা হয়েছিল বিএলএফ। বিএলএফ যুদ্ধকৌশল হিসাবে সীমান্তের ওপারে নয়, সীমান্তের অভ্যন্তরে দেশের ভেতরে অবস্থান করে গেরিলা যুদ্ধ ও জনযুদ্ধ পরিচালনা করার পাশাপাশি জনগণকে রাজনৈতিক, আদর্শিক ও সামরিকভাবে প্রশিক্ষিত করে পুরো জনগণকেই গেরিলা যোদ্ধায় উন্নীত করার কাজ করে। বিএলএফ এবং ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের দেশব্যাপী বিস্তৃত এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই গণবাহিনী (মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিফৌজ) এবং মিত্রবাহিনী দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যুদ্ধ করেছিল। বিএলএফ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সামরিক ও রাজনৈতিক-আদর্শিকভাবে প্রশিক্ষিত গেরিলাদের নিয়ে সারা দেশকে চারটি আঞ্চলে বিভক্ত করে চারটি যুদ্ধ কমান্ড গঠন করা হয়েছিল। কমান্ডগুলির অধিনায়ক ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। বিএলএফ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে ১১ হাজার গেরিলা যোদ্ধা এই চারটি কমান্ডের অধীনে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই চারটি কমান্ডের অধীনে সকল জেলা, মহকুমা, থানা পর্যায়ে বিএলএফ-এর কমান্ড ইউনিট গঠন করা হয়েছিল। তারা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জেলা, মহকুমা, থানা, শহর ও গ্রাম পর্যায়ে আরও পঞ্চাশ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অসংখ্য জেলা-উপজেলায় বিএলএফ-এর নেতৃবৃন্দের হাতেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও পাক প্রশাসন আত্মসমর্পণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে কয়েক হাজার বিএলএফ-এর যোদ্ধা সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ ও আহত হন।
জনাব কাইয়ূম বলেন, বিএলএফ-এর গেরিলা যুদ্ধের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্প, রিক্রুটমেন্ট শাখা, অস্থায়ী সরকারের সাথে সমন্বয় শাখা, গোয়েন্দা শাখা ছিল। যুদ্ধে সামরিক ও রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাসানুল হক ইনু প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষক ও ক্যাম্প কমান্ডেন্ট ছিলেন। গেরিলা যোদ্ধাদের সামরিক ও রাজনৈতিক-আদর্শিকভাবে প্রশিক্ষিত করার গুরুত্বপূর্ণ কাজকে যিনি বা যারা গুরুত্বহীন মনে করেন তাদের যুদ্ধবিদ্যার সাধারণ জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলা কি অন্যায় হবে? হাসানুল হক ইনুর প্রশিক্ষক ও ক্যাম্প কমান্ডেন্ট হিসাবে তার এই ভূমিকা এবং বিএলএফ-এর চার আঞ্চলিক অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের ভূমিকাকে যদি বলা হয় তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি তাহলে এর উত্তরে বলতে হয়, এটা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের মত ‘মেধাবী মার্কসবাদী তাত্ত্বিক’ মানুষের অজ্ঞতা নয়, জ্ঞান পাপের পর্যায়েই পরে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বিএলএফ সদস্যদের রাজনৈতিক দীক্ষা নিয়েও যা বলেছেন তাও তার মনগড়া ও বিদ্বেষপ্রসূত। বিএলএফ ক্যাম্পের প্রশিক্ষণে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠায় বিপ্লবী গেরিলাদের রাজনৈতিক ভূমিকা কি হবে তার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। বিএলএফ সদস্যদের অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের সাথে বিরোধ করার নির্দেশনা দেয়াতো দূরের কথা বরং সকল মুক্তিযোদ্ধাদের কিভাবে সমন্বিত করে দীর্ঘমেয়াদি প্রলম্বিত যুদ্ধের লক্ষ্যে সংগঠিত ও পরিচালিত করা যায়Ñসেই দীক্ষাই দেয়া হয়েছিল।
জনাব কাইয়ূম বলেন, আওয়ামী লীগ ও ভারতের বিরোধীতা করতে গিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার যে কৌশল শুরু থেকেই প্রয়োগ করে আসছে, সেই কৌশলকেই কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের মত ‘মেধাবী মার্কসবাদী তাত্ত্বিক’ নেতার প্রয়োগ করা সমগ্র জাতির জন্য দূর্ভাগ্যজনক।