আমরা সময়ের কথা সময়ে বলি।

Advertisement

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা আসলে সেই ১৯৪৮ সালে ফিরে যেতে হবে

বিশেষ প্রতিবেদন, মুক্তমত, রাজনীতি 22 March 2020 ৭৫৪

ডেস্ক।।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা আসলে সেই ১৯৪৮ সালে ফিরে যেতে হবে, যখন ঢাকায় মোহাম্মদত আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন যে উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এতে পূর্ব পাকিস্তানে মারাত্মক অসন্তোষ দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে অঞ্চলটিতে ক্ষোভ বাড়তে থাকে, বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও বুদ্ধিজীবীকে জীবন দিতে হয়েছে বাংলাভাষীদের ওপর উর্দু চাপিয়ে দেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, সেই জেরে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান। যখন ভাষা আন্দোলন নতুন গতিশক্তি পায়, পূর্ব পাকিস্তানে ধর্ম তখন পেছনের আসনে চলে যায়, গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।  এ অঞ্চলে ধর্ম কখনোই গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক ছিল না– এতে তা আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) সঙ্গে তুলনা করলে যা সম্পূর্ণ আলাদা, সেখানে সবকিছু ধর্মের মাপকাঠিতে দেখা হয় এবং মানুষও বিভিন্ন ধর্মীয় ধরা-উপধারায় বিভক্ত। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব যার একটি উদহারণ।পরবর্তীকালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে ইউনেস্কো। কাজেই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ তৈরি করে দিয়েছিল ভাষা।পূর্ব পাকিস্তানিরা হৃদয় থেকেই নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিয়ে আসছে। তাদের সংস্কৃতিতেও বাঙালিয়ানা প্রতিমূর্ত হয়ে ওঠে। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের লোকজন এগিয়ে ছিলেন। সেই সময় পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যাপীঠ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ আসন দখল করে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।উপরের ঘটনাগুলো এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ যে ঢাকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মিশন ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে। যেটা এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের চেতনা ও মনোভাবের প্রতি সম্পূর্ণ অসম্মানজনক।তারা দেখাতে চাচ্ছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের আধিপত্য থেকে ১৯৪০ সালের দিকে মুসলমান স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হন, যে কারণে তাদের এই দিবস ( মার্চ ২৩) গুরুত্বপূর্ণ। যাই হোক, তারা এ বিষয়টি উল্লেখ করতে ভুলে গেছে যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ওপর যে দেশের ভিত্তি গড়ে উঠেছে, সেখানে ধর্মীয় কার্ড খেলে তারা কোনো ফল পাবে না। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত জাগিয়ে তুলতে ও প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিভাজন তৈরির বিশেষ মিশন থেকেই তারা এটা করছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে সেই দেশের অবিচল সমর্থন ও কৃতজ্ঞতার ঋণ কখনো শোধ করা সম্ভব না। গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে দুঃখপ্রকাশ না করে তারা ২৩ মার্চের নিজস্ব এজেন্ডায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, তাও এমন সময় যখন মুজিববর্ষ চলছে। বাংলাদেশ এমন এক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে, উপমহাদেশের ইতিহাসে তা সম্ভবত অনন্য। সেই লড়াইয়ের গভীরে নজর দিলে পাকিস্তানের অসুভ পরিকল্পনা ও ভণ্ডামি বেরিয়ে আসবে। পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববাংলা সৃষ্টির মাধ্যমে ১০৫ সালে ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাকে বিভিক্ত করতে চেয়েছিল ব্রিটিশরা। সেটা ছিল প্রথম কোনো উদ্যোগ। তখন পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আর পূর্ববাংলায় মুসলমানরা। কিন্তু ধর্মীয় ধারার সেই বিভক্তি স্থায়ী হয়নি এবং প্রতিরোধের মুখে ১৯১১ সালে তা অকার্যকর হয়ে যায়। ব্রিটিশরা যখন স্বাধীন ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে যাচ্ছিল, তখনকার অবিভক্ত ভারতে আরেকবার ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। যা উপমহাদেশের ইতিহাসে দ্বিজাতি তত্ত্ব নামে পরিচিত। কিন্তু এবার জিন্নাহ সফল হয়ে যান। অবিভক্ত ভারত ভাগ হওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। যেখানে ভারত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ আর পাকিস্তানের জনসংখ্যার মূল অংশ মুসলমানরা। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি অংশ হয় পাকিস্তানের। কিন্তু একটি অংশ থেকে আরেকটি দুই হাজার কিলোমিটার দূরে।কেবল দুই অংশের ব্যাপক বিভাজনের মধ্যেই এই বিচ্ছিন্নতা সীমাবদ্ধ নয়; ভাষা ও সাংস্কৃতিকভাবেও অমিল ছিল। কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির জন্য পরের দুটির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদন (১৯৭০ সালের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার জন্য উপদেষ্টা প্যানেলের প্রতিবেদন) অনুসারে, সবসময়ই পূর্ব পাকিস্তানের সর্বমোট ব্যয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে কম। ১৯৫০/৫১-১৯৫৪/৫৫ সালে, সর্বমোট ৪৬ শতাংশ খরচ ছিল পূর্বাংশের, আর বাকিটা পশ্চিমাংশে চলে যেত। ১৯৫৫/৫৬-১৯৫৯/৬০ সালে পূর্বাংশের ব্যয় আরও কমে ৩২ শতাংশ হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তান জনবহুল হলেও সেখানে ১৯৫০/৫১-১৯৬৯/৭০ সালে গড়ে ৩৪ শতাংশ হারে খরচ হয়েছে। ১৯৪৮ এবং ১৯৬০ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের রফতানি আয় ছিল ৭০ শতাংশ, তখন তারা মাত্র ২৫ শতাংশ রফতানি আয় নিজেরা পেত। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ১১টি টেক্সাইল মিল ছিল, যখন পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৯টি। কিন্তু ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের টেক্সাইল মিলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৫০, আর পর্ব পাকিস্তানের ছিল মাত্র ২৬টি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে দুই দশমিক ছয় বিলিয়ন ডলারের (১৯৭১ বিনিময় হার) সমপরিমাণ সম্পদ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উপরের এই পরিসংখ্যান পরিষ্কারভাবে বলে দিচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক শোষণ ও অর্থপাচারের আশ্রয় নিয়েছিল পাকিস্তান (তখনকার পশ্চিম পাকিস্তান)। আর এসব কারণেই পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতার ডাক দিতে হয়েছে। এভাবেই ইসলামি ভ্রাতৃত্বের ভণ্ডামির আরেকটি দৃষ্টান্ত তৈরি করে পাকিস্তান। প্রতিবছরের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উদযাপিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চে অপারেশন সার্চলাইটের পর মুসলমান জনগণের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের ধাপ্পাবাজির আরেকটি উদহারণ এটি। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার বড় অংশ মুসলমান। রাত সাড়ে ১১টায় পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা ক্যান্টনমেন্টে আসে, ফার্মগেট এলাকায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা চালায়। একই সময় তারা পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসেও হামলা চালায়। আর রাত সোয়া ১টায় শেখ মুজিবর রহমানকে তার বাসভবন থেকে আটক করা হয়। আটকের কয়েক মিনিট আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন শেখ মুজিবর রহমান। সেই অন্ধকার রাতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টারে তারা অভিযান চালায় এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হত্যা করে।সবশেষে যে কেউ সহজেই বুঝতে পারবেন যে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক শোষণ ও আধিপত্যের কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ধর্ম এখানে কোনো অনুঘটকের ভূমিকা রাখেনি।২০২০ সালের ১৭ মার্চ শুরু হওয়া মুজিববর্ষ ২০২১ সাল পর্যন্ত পালিত হবে। যা সাম্প্রদায়িক ঘৃণা উসকে দিতে পাকিস্তানের অশুভ পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেবে। কাজেই ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উদযাপন পরিষ্কারভাবে কূটনৈতিক মিশনগুলোর ন্যাক্কারজনক উদ্যোগ। ২৫-২৬ মার্চ রাতের অন্ধকারে নিরাপরাধ বেসামরিক লোকজনের ওপর হিংস্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হানা দেয়ার সেই ক্ষত তারা ভুলে গেছে। সেই রাতে নৃশংস রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামসের সহায়তায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী গণহত্যা সংঘটিত করেছিল। যখন বছরজুড়ে নানা আয়োজনে মুজিববর্ষ পালিত হচ্ছে, তখন ১৬ কোটি বাংলাদেশির চেতনা ও মানসিকতার ওপর ন্যূনতম সম্মান না দেখিয়ে এই চক্র তাদের সরকারের এজেন্ডাকেই সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের পদক্ষেপ অবশ্যই নিন্দনীয় ও তাদের গোপন ষড়যন্ত্রের সঙ্গেই তা সামঞ্জস্যপূর্ণ।