আমরা সময়ের কথা সময়ে বলি।

Advertisement

জানাজায় এত জনসমাগম হলো কি ভাবে

বিশেষ প্রতিবেদন, সারাদেশ 20 April 2020 ৭৪৯

রিপন চৌধূরী।।

করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি সত্ত্বেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির আল্লামা হাফেজ জুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় অজস্র মানুষের ঢল নামার পর সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জেগেছে, জেলাজুড়ে গত ১১ এপ্রিল থেকে লকডাউন চলছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও জানাজায় এত জনসমাগম কীভাবে হলো? স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শুধু আশপাশের গ্রাম থেকেই নয়, পার্শ্ববর্তী হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলারও বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে লোকজন জুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় যোগ দিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে যান। তারা মূলত পিকআপ, ভ্যানগাড়ি, ইজিবাইক ও সাইকেলে চড়ে জানাজায় যোগ দেন।এ সময় মহাসড়কে তাদের কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া আশপাশের অনেক উপজেলা থেকে এবং হাওরাঞ্চল থেকে দলে দলে নৌকায় করে এসেও জানাজায় অংশ নেন সদ্যপ্রয়াতের অনেক ভক্ত। এদিকে জানাজায় বিপুলসংখ্যক মানুষের জমায়েতকা-ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারায় পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তারা হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সহকারী পুলিশ সুপার (সরাইল সার্কেল) মো. মাসুদ রানা, সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাহাদাত হোসেন টিটু এবং সরাইল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নূরুল হক। গত শনিবার রাতেই সরাইল থানার ওসি সাহাদাত হোসেন টিটুকে এবং গতকাল অপর দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (প্রশাসন ও অর্থ) মো. ইকবাল হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) পঙ্কজ কুমার দে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আলমগীর হোসেন। কমিটিকে আগামী ২২ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে গণজমায়েতের এ ঘটনায় গতকাল রবিবার অনলাইন ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, জানাজায় হাজার হাজার মানুষের জমায়েত খুবই ক্ষতিকর হয়েছে। এতে ঝুঁকি তৈরি হলো। অনেক লোক আক্রান্ত হতে পারে। তিনি আরও বলেন, জানাজায় লোকসমাগম নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু জানাজায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে এখনই প্রশাসনের নজরদারি জরুরি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মো. একরাম উল্লাহ গতকাল গণমাধ্যমকে বলেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত অনেক রোগী পাওয়া গেছে। এ জনসমাগমের ফলে সেই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। তিনি জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাদ্রাসার আশপাশের আটটি গ্রাম লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে।

জানাজায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতি সিভিল সার্জনের আহ্বান

ওই গণজমায়েতে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের উদ্দেশে সিভিল সার্জন ডা. মো. একরাম উল্লাহ বলেন, ‘আমরা সেখানে অংশ নেওয়া সবাইকে আহ্বান করছি, তারা যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন; সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখেন। কারও মধ্যে উপসর্গ দেখা গেলেই যেন আমাদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেন। তা হলে তাদের নমুনা সংগ্রহ করে আমরা পরীক্ষার ব্যবস্থা করব।’নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর, গত শুক্রবার রাতে আল্লামা হাফেজ জুবায়ের আহমদ আনসারীর মৃত্যুর পরপরই পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমানের নির্দেশে সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাহাদাত হোসেন টিটু যান জামিয়া রাহমানিয়া বেড়তলা মাদ্রাসায় এবং মাদ্রাসা কমিটির সঙ্গে কথা বলে সংক্ষিপ্তাকারে জানাজা অনুষ্ঠানের অনুরোধ জানান। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ প্রশাসনকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। এর পরপরই বিভিন্ন মসজিদের মাইকে তার মৃত্যু-সংবাদ ঘোষণা করা হয় এবং জানাজার সময় জানিয়ে দেওয়া হয়।ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ পুলিশকে আশ্বস্ত করলেও ভোরেই বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন জমায়েত হতে থাকেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের প্রতিহত করা সম্ভবপর ছিল না। এদিকে করোনার প্রাদুর্ভাব রোধে সরাইল উপজেলার বেড়তলা, সীতাহরণ ও আশুগঞ্জ উপজেলা বগুইর, খড়িয়ালা গ্রামসহ আশপাশের ৮টি গ্রামের মানুষকে ১৪ দিন ঘর থেকে বের না হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। গত শনিবার সন্ধ্যায় সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এএসএম মূসা মোবাইল ফোনে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বেড়তলা এবং আশপাশের গ্রামগুলোতে আমরা মাইকিং করে বলে দিয়েছি কেউ যেন ঘর থেকে বের না হন। আগামী ১৪-১৫ দিন তারা যেন কোয়ারেন্টিন মেনে চলেন। স্থানীয় মেম্বারদের নেতৃত্বে যুবসমাজ দিয়ে আমরা কমিটি গঠন করে দিচ্ছি, তারা যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন। তাদের সুরক্ষার জন্য একান্তই হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন বের না হন। আমরা হ্যান্ডমাইক ব্যবহার করে সবাইকে বলে দিয়েছি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সমালোচনার ঝড়

লকডাউন উপেক্ষা করে জুবায়ের আহমদ আনসারীর নামাজে জানাজায় বিপুল জনসমাগমের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও সমালোচনার ঝড় বইছে। পুলিশের সামনেই ট্রাক, পিকআপ ও ভ্যানে করে ঢাকাসহ আশপাশের জেলা থেকে কীভাবে এত লোক জানাজায় অংশগ্রহণ করেছেÑ এ প্রশ্ন সামনে রেখেই চলছে নানাবিধ সমালোচনা। এ ব্যাপারে সরাইল থানার সদ্য প্রত্যাহারকৃত ওসি সাহাদাত হোসেন টিটু বলেন, জানাজায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াও ঢাকা ও আশপাশের অনেক জেলা থেকে লোকজন যোগ দেন। আমরা তাদের ঠেকানোর অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। এ ছাড়া আমরা চিন্তাও করতে পারিনি যে, এত লোক হবে। এদিকে জানাজায় জনসমাগমের বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকার বলেন, এটা থেকে বোঝা যায়, আমাদের মাঝে সচেতনতার কতটা অভাব। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ দিয়ে এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া মোটেও সম্ভব না বলে মনে করেন তিনি।

মাধবপুরের ১০ জনের বাড়িতে লকডাউন

মাধবপুর প্রতিনিধি জানান, আনসারীর জানাজায় হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে অংশ নেওয়া ১০ জনের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে তাদের বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। গতকাল রবিবার বিকালে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আয়েশা আক্তার, এসআই আজিজুর রহমান নাঈম উপজেলা সদরের ৮টি এবং উপজেলার বাইরে ২টি বাড়ি লকডাউন করেন।